দানবীর হাতেম তায় এর নাম শোনে নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোট বেলায় পাঠ্যবইয়ের সুবাদে তার নাম না জানা মানুষ উপমহাদেশে বিরল। অনেকেই তাকে রূপকথার চরিত্র হিসেবেই মনে করে, অথচ তিনি সত্যিকারের রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন! তার পরোপকার আর মহৎ হৃদয়ের গল্প এতটাই অবিশ্বাস্য যে তিনি ইতিহাসের তাম্রলিপিতে স্থান পেয়ে গেছেন। এই আধূনিক যুগেও এমনি এক হাতিম তায় এর খোঁজ পাওয়া গেছে শেরপুরের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেও পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ নিরবে-নিভৃতে এ পেশা থেকে আয় করা সিংহ ভাগ নগদ অর্থ তিনি এলাকার শিশুদের জন্য ব্যয় করে যাচ্ছেন। প্রতিমাসে তার সে ব্যয়ের পরিমান প্রায় লাখ টাকা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের ডাকরা পাড়া গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পল্লী চিকিৎসক হাবিবুর রহমান ওরফে জব্বার ডাক্তার প্রায় ত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন এভাবেই ছুটে চলেন গ্রামীণ রাস্তা ও গ্রামের বিভিন্ন পাড়ার বাড়ি বাড়ি। সাথে নেন একটি সোপিং ব্যাগ। সে ব্যাগে থাকেন দশ ও বিশ টাকা নোটের নগদ ৩ হাজার টাকা এবং কিছু বিস্কুট ও চকোলেট। বাসায় আগে থেকেই প্রতিদিনের জন্য ৩ হাজার টাকা খুচরো করে রাখেন তিনি। এরপর বেরিয়ে পড়েন দানের উদ্যেশে। কোলের শিশুসহ স্কুলগামী শিশুদের মাঝে তিনি সেই টাকা এবং চকোলেট ও বিস্কুট বিলিয়ে দেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত গ্রাম ঘুরে বাড়ি ফিরেন দুপুর বেলা। এরপর দুপরের খাবার খেয়ে বিকেলে স্থানীয় ঝগড়ারচর বাজারে তার নিজস্ব ভবনের ফার্মেসিতে বসেন। প্রতিদিন সে পাড়া পাড়া ভাগ করে ঘুরেন শেরপুর সদর উপজেলার কিছু অংশ, জামালপুরের বক্সীগঞ্জ, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ এবং শ্রীবর্দী উপজেলার প্রায় ১০ থেকে ১৫ টি গ্রাম। ভোগৌলিকগত কারণে উল্লেখিত উপজেলার গ্রামগুলো ডাকরাপাড়া গ্রামের কাছাকাছি।
তার ওই অর্থ ও খাদ্য বিতরণের সময় যদি কোন শিশু বাড়িতে না থাকে তখন তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয় টাকা বিস্কুট-চকোলেট। তার এ দানের বিষয়ে খুশি শিশু এবং এলাকার সাধারণ মানুষ। কেউ তাকে দাদু আবার কেউ তাকে জ্যাঠা বলে সম্বোধন করে থাকেন।
জব্বার ডাক্তার একাত্তরে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফরমফিলাপ করলেও যুদ্ধে যাওয়ার কারণে সে বছর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তিনি ১১ নং সেক্টরে কর্নেল তাহের এর সাথে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে তার মা ও বাবা দু’জনক হারিয়ে ৯ ভাই-বোনের সংসারের চাপে পড়ে যান তিনি। পরিবারের সবার বড় হওয়ার কারণে ৮ বোনকে বিয়ে দিতে গিয়ে তার আর নিজের সংসার করা হয়নি। ১৯৭৯ সালে তিনি পল্লী চিকিৎসকের পরীক্ষা দিয়ে শেরপুর জেলার প্রথম হন তিনি। এরপর ঝগড়ার চর বাজারে চেম্বার খুলে একটি ঔষুদের ফার্মেসি দেন তিনি। শুরু করেন বিনামূল্যে রোগী দেখা। তবে শুধু ঔষুদের দাম রাখেন তিনি। তার চিকিৎসায় রোগীরা ভালো হওয়ায় আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। রোগীরাও খুশি তার চিকিৎসায় ও শিশুদের প্রতি ভালোবাসা দেখে। যকোন শিশু রোগি চিৎকার করলে তিনি তাকে কোলে নিয়েই শান্ত করে ফেলেন। এরপর গালে চুমু খেয়ে চিকিৎসা শুরু করেন।
পল্লী চিকিৎসকের লাইসেন্স থাকলেও তিনি এলোপ্যাথির পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসাও করে থাকেন। কারণ তিনি পল্লী চিকিৎসকের পরীক্ষা দেয়ার আগ পর্যন্ত ঝগরার চর বাজারে স্থানীয় এক ডক্তারের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি হোমিও চিকিৎসাতেও বেশ পারদশি বলে জানায় স্থানীয়রা।
জব্বার ডাক্তারের আত্মীয়রা তার এই মহতি কাজের জন্য বেশ প্রশংসা করেন এবং গর্ববোধ করেন। তারা জানায়, তিনি শুধু মানুষকেই ভালোবাসে না, আশপাশের কুকুর-বেড়ালও তার খুব ভক্ত। তিনি যতক্ষন বাড়িতে থাকেন ততক্ষণ তার চার পাশে ও বাড়ির উঠান ঘিরে থাকে অসংখ্য কুকুর-বেড়াল। জব্বার ডক্তার এসব কুকুর-বেড়ালকে ভালোবেসে প্রতিদিন নিজ হাতে খাবার দেন। সেকারণে ঘরের ভেতর সব সময় বেড়াল এবং ঘরের বাইরে দরজার সামনে কুকুর বসে থাকে।
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ওরফে জব্বার ডাক্তার জানায়, দেশ স্বাধীন করে আসার পর বাবা-মা জীবিত থাকায় কয়েক বছর ঘোরাফেরা করেই সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের পর বাবা ও মা মারা যাওয়ায় তার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। কি করবে, কীভাবে সংসার চালাবে কুলকিনারা পাচ্ছিলো না। তিনিসহ ৮ বোনের বিশাল সংসার। সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলো। দাদার বিশাল সহায় সম্বল থাকলেও বাব-চাচাদের জন্য কিছুই রেখে যায়নি। সব জমিজমা বর্গাদার আর ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে যায়। ফলে পৈত্রিক সম্পদ পায় মাত্র ১৩ শতকের ভিটে বাড়িটি। এরপর পল্লী চিকিৎকের পেশায় থেকে জীবনের গতি কিছুটা সচল করেন। এর আগে তিনি নানান পেয়লশায় জড়িত থাকলেও কোন পেশাতেই তিনি সফল হতে পারেনি।
জব্বার ডক্তার জানায়, তার প্রৈত্রিক মাত্র ১৩ শতক বাড়ি ভিটের জমিটি ৮ বোন তাদের ওয়ারিশ না নিয়ে ভাইয়ের নামে লিখে দেওয়ায় বোনেদের প্রতি গভির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্মায় তার। এছাড়া শিশুদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তার এ অর্থ বিতরণ করে থাকেন বলে জানায় তিনি। তিনি বাকী জীবন এভাবেই শিশুদের ভালোবেসে তার ব্যবসার সিংগভাগ অর্থ ব্যয় করে যাবেন বলেও জানান তিনি।
গ্রামের সাধারণ মানুষ মনে করেন হাতিম তায় এর মতো নিজের মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ও ব্যবসার অর্থ বিলিয়ে দেয়া জব্বর ডাক্তারের মতো আরো ডাক্তার ঘরের ঘরে জন্ম হোক। এতে বদলে যাবে সমাজের চিত্র। তার এ দানশীলতায় উদ্ধুদ্ধ হোক আরো অনেকেই, এমনটি আশা করেন এলাকার সচেতন মানুষ।