জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতা। তারা হলেনÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। এই চার জাতীয় নেতা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে ঘাতক কর্তৃক নিহত হন। তাদের উত্তরসূরিরা কে কোথায় কেমন আছেন তা নিয়ে আজকের আলোকপাত।
চার নেতার অন্যতম ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম খুবই সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রীর দায়িত্বও তিনি সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দলকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে তার বিখ্যাত একটি উক্তিই সেটির বাস্তব প্রমাণ। উক্তিটি ছিল, আওয়ামী লীগ একটি সংগঠন নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও সৈয়দ জাকিয়া নূর লিপি দলে বাবা কিংবা ভাইয়ের মতো বলিষ্ঠ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৮১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন এবং সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, তখন তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিণী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। বয়সের ভারে একসময় তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিলে শেখ হাসিনা দলে নিয়ে আসেন তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে তানজিম আহমদ সোহেল তাজকে। দলে এসে প্রথমবার এমপি হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে সিমিন হোসেন রিমিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিমিন হোসেন রিমি বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তাজউদ্দীন আহমদ যে মাপের নেতা ছিলেন তার ছেলেমেয়ে হিসেবে তারা সেভাবে এগোতে পারেননি।
জাতীয় চার নেতার আরেক অন্যতম নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর দুই ছেলের একজন ড. মোহাম্মদ সেলিম এবং অপরজন মোহাম্মদ নাসিম। ছাত্রজীবন থেকেই নাসিম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও জড়িয়ে যান মোহাম্মদ নাসিম। বড় ভাই ড. মোহাম্মদ সেলিম যদিও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন কিন্তু তিনি নাসিমের মতো লাইমলাইটে আসতে পারেননি। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকা অবস্থায় ড. সেলিম মারা যান। মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে গেছেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোহাম্মদ নাসিম মৃত্যুবরণ করলেও তার ছেলে তানভির শাকিল জয় আওয়ামী লীগ থেকে সিরাজগঞ্জের একটি আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয়ভাবে তানভির শাকিল জয় বাবার মতো ততটা পরিচিত না হলেও সংসদ সদস্য হিসেবে তার কার্যক্রম সন্তোষজনক।
জাতীয় চার নেতার আরেক বর্ষীয়ান নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। অন্য তিন নেতার সঙ্গে তাকেও নির্মমভাবে জেলখানায় হত্যা করা হয়। তার ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে না হলেও রাজশাহীর রাজনীতিতে তিনি বিশাল ফ্যাক্টর। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির শক্ত ভিত করেছেন খায়রুজ্জামান লিটন। একসময় রাজশাহীতে বিএনপি এবং শিবিরের ঘাঁটি থাকলেও বর্তমানে এই অঞ্চলে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগকে এমন একটি পর্যায়ে নেওয়ার এ কৃতিত্ব খায়রুজ্জামান লিটনের।
জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডের সময় এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তার ছোট ভাই ভারতের কলকাতায় একটি মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করতেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেন। এর আগেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে জাতীয় চার নেতার স্ত্রী-সন্তানদের যথাযথ সম্মান, স্নেহ ও মর্যাদা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। জাতীয় চার নেতার সন্তানদের রাজনীতিতে এনে তাদের প্রতি শেখ হাসিনার যে অকৃত্রিম ভালোবাসা, তা জাতির কাছে প্রমাণিত।