ঢাকা ০৮:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনে ভারতই ফ্যাক্ট!

  • যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা ভারতের
  • ভূরাজনৈতিক কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন
  • নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপও

সাইফ আশরাফ

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের শীর্ষ পর্যায়ের টু প্লাস টু বৈঠকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত। বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়Ñভারতের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা।
গত শুক্রবার দিল্লিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ লয়েড অস্টিন। বৈঠকে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠে আসা ও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেভাবে নানা মন্তব্য করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা, তার বিপরীতে গিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে মার্কিন মন্ত্রীদের সামনে তুলে ধরার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষছেন দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধারা। প্রশ্ন উঠে আসছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির চলমান চাপ তাতে কতটা প্রভাবিত হবে।
দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরকে জানিয়েছি। মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করি, তাও স্পষ্টভাবে জানিয়েছি। মূলত, এই আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়টিও উঠে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। আমি মনে করি, যখন বাংলাদেশের উন্নয়ন বা নির্বাচনের কথা আসে, তখন এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার। সে হিসেবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং দেশটির জনগণ নিজেদের জন্য যে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল অবস্থা দেখতে চায়, আমরা সেই আকাক্সক্ষাকেই সমর্থন দেব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরার অর্থ আমেরিকা যাতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ না দেয়, সেই বার্তাই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ভারত। ভারত তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের নিবাঁচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ সমর্থন করছে না।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের অবস্থান স্পষ্টই ছিল, কিন্তু সেটা খুব স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিবের সামনে তুলে ধরাটা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে আমাদের। ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীল সরকার থাকা খুবই জরুরি; আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে। সে দেশের ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শেখ হাসিনার সরকারের ওপরে নানাভাবে চাপ বাড়াচ্ছে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও তারা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, সেগুলো তো ঘটনা। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যাতে তারা বেশি মাথা না ঘামায়, সেটা ভারত স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) বিশেষজ্ঞ রিক রসো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ইস্যুগুলোর প্রভাবই কিন্তু বেশি থাকবে। গাজা বা ইউক্রেনের যুদ্ধের চেয়ে বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কায় কী ঘটছে, সেটাই কিন্তু ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।
পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ শশাঙ্ক মাট্টু তার এক্স হ্যাণ্ডেলে লিখেছেন, ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বন্দ্বে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের মাথা গলানোর কারণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হুমকির মুখে পড়ছে। ওয়াশিংটন প্রকাশ্যেই হাসিনা সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসিনা সরকার আর আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে মানবাধিকার ইস্যুতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকার অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হলেন শেখ হাসিনা। তিনি যদি নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে প্রতিবেশীদের নিয়ে ভারতের নীতিমালাতেও সমস্যা হবে।
নির্বাচন বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এ ক্ষেত্রে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত কী ভূমিকা নেয়; সেটি যে প্রভাব ফেলে তাতে সন্দেহ নেই। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্ক থাকায় ভারতের অবস্থান কী হয় সেটিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরেও ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে জোরালো সমর্থন দিয়ে গেছে। ভারতের সমর্থনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব বিগত দুটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে জোরালো আপত্তি তোলেনি। গত আগস্টে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদে দাবি করা হয়Ñশেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনীতিক বার্তা দিয়েছে ভারত।
গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারত একই সুরে কথা বলবে। এটাই আমার ধারণা ছিল। তাহলে হয়তো বা আমাদের দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফেরত পেতে সহজ হতো। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু না হয়ে শুধু একটি দলের বন্ধু হয়েছে। তারা একটা দলের বন্ধু। একজন ব্যক্তির বন্ধু। এ অবস্থানটা কোনোভাবেই জনগণের জন্য কাম্য না। ভারত তো চায় আজীবন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, যেভাবে খুশি, এটা তো সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেকোনো সময়ের থেকে উল্লেখযোগ্য অবস্থায় গেছে। ভারত তার নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশে স্থীতিশীলতা চাইবে। বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিদেশি বাণিজ্য তৈরি করছে। তাতে ভারত, চীন, আমেরিকার আগ্রহ তৈরি করেছে। ভারত তার সেভেন সিস্টার রাজ্য, বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রভৃতি কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। যা আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।
গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সালেহ সেকেন্দার বলেন, দক্ষিণ-এশিয়ায় চীনের আধিপত্য রুখতে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ-ভারতের যে সম্পর্ক আগে ছিল এবং এখন আছে তাতে ভারতের অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রর যে কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তা প্রভাবিত করবে।

ট্যাগস :

নির্বাচনে ভারতই ফ্যাক্ট!

আপডেট সময় : ০৯:১৬:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০২৩
  • যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা ভারতের
  • ভূরাজনৈতিক কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন
  • নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপও

সাইফ আশরাফ

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের শীর্ষ পর্যায়ের টু প্লাস টু বৈঠকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত। বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়Ñভারতের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা।
গত শুক্রবার দিল্লিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ লয়েড অস্টিন। বৈঠকে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে অন্যান্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠে আসা ও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেভাবে নানা মন্তব্য করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা, তার বিপরীতে গিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে মার্কিন মন্ত্রীদের সামনে তুলে ধরার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষছেন দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধারা। প্রশ্ন উঠে আসছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির চলমান চাপ তাতে কতটা প্রভাবিত হবে।
দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরকে জানিয়েছি। মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করি, তাও স্পষ্টভাবে জানিয়েছি। মূলত, এই আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়টিও উঠে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। আমি মনে করি, যখন বাংলাদেশের উন্নয়ন বা নির্বাচনের কথা আসে, তখন এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার। সে হিসেবে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং দেশটির জনগণ নিজেদের জন্য যে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল অবস্থা দেখতে চায়, আমরা সেই আকাক্সক্ষাকেই সমর্থন দেব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরার অর্থ আমেরিকা যাতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ না দেয়, সেই বার্তাই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ভারত। ভারত তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের নিবাঁচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ সমর্থন করছে না।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের অবস্থান স্পষ্টই ছিল, কিন্তু সেটা খুব স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিবের সামনে তুলে ধরাটা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে আমাদের। ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীল সরকার থাকা খুবই জরুরি; আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে। সে দেশের ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শেখ হাসিনার সরকারের ওপরে নানাভাবে চাপ বাড়াচ্ছে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও তারা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, সেগুলো তো ঘটনা। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যাতে তারা বেশি মাথা না ঘামায়, সেটা ভারত স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) বিশেষজ্ঞ রিক রসো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ইস্যুগুলোর প্রভাবই কিন্তু বেশি থাকবে। গাজা বা ইউক্রেনের যুদ্ধের চেয়ে বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কায় কী ঘটছে, সেটাই কিন্তু ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।
পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ শশাঙ্ক মাট্টু তার এক্স হ্যাণ্ডেলে লিখেছেন, ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বন্দ্বে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের মাথা গলানোর কারণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হুমকির মুখে পড়ছে। ওয়াশিংটন প্রকাশ্যেই হাসিনা সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসিনা সরকার আর আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে মানবাধিকার ইস্যুতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকার অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হলেন শেখ হাসিনা। তিনি যদি নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে প্রতিবেশীদের নিয়ে ভারতের নীতিমালাতেও সমস্যা হবে।
নির্বাচন বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এ ক্ষেত্রে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত কী ভূমিকা নেয়; সেটি যে প্রভাব ফেলে তাতে সন্দেহ নেই। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্ক থাকায় ভারতের অবস্থান কী হয় সেটিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরেও ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে জোরালো সমর্থন দিয়ে গেছে। ভারতের সমর্থনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব বিগত দুটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে জোরালো আপত্তি তোলেনি। গত আগস্টে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদে দাবি করা হয়Ñশেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনীতিক বার্তা দিয়েছে ভারত।
গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারত একই সুরে কথা বলবে। এটাই আমার ধারণা ছিল। তাহলে হয়তো বা আমাদের দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফেরত পেতে সহজ হতো। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু না হয়ে শুধু একটি দলের বন্ধু হয়েছে। তারা একটা দলের বন্ধু। একজন ব্যক্তির বন্ধু। এ অবস্থানটা কোনোভাবেই জনগণের জন্য কাম্য না। ভারত তো চায় আজীবন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, যেভাবে খুশি, এটা তো সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেকোনো সময়ের থেকে উল্লেখযোগ্য অবস্থায় গেছে। ভারত তার নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশে স্থীতিশীলতা চাইবে। বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিদেশি বাণিজ্য তৈরি করছে। তাতে ভারত, চীন, আমেরিকার আগ্রহ তৈরি করেছে। ভারত তার সেভেন সিস্টার রাজ্য, বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রভৃতি কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। যা আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।
গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সালেহ সেকেন্দার বলেন, দক্ষিণ-এশিয়ায় চীনের আধিপত্য রুখতে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ-ভারতের যে সম্পর্ক আগে ছিল এবং এখন আছে তাতে ভারতের অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রর যে কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তা প্রভাবিত করবে।