ঢাকা ০৬:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতি বছর আত্মহত্যা করছেন আড়াই থেকে তিনশ’ মানুষ অধিকাংশ নারী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

 গত ২ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আত্মহত্যা করেছে ৪৮ জন। তবে  জেলা সদর হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন- আগের তুলনায় এ সংখ্যা বেশি বলা যাবে না। জেলায় প্রতি বছর আড়াই থেকে তিনশ’ লোক আত্মহত্যা করে বলে তথ্য দেন তারা। স্ত্রী বা স্বামীর পরকীয়া সম্পর্ক, মোবাইল ব্যবহারে বাধা, স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক বিরোধ এবং অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাদের অনেকে। আত্মহত্যাকারীদের অধিকাংশ নারী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার (২০) বাসায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। গত শুক্রবার রাত ৮ টার দিকে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।  কসবার কুটি ইউনিয়নের মাইঝখার গ্রামের মোস্তফা কামালের মেয়ে সাদিয়া জেলা শহরের পশ্চিম মেড্ডার সিও অফিস এলাকায় মদিনা টাওয়ার নামীয় একটি বহুতল বাড়ির ৫ তলায় একাই থাকতো।

তবে লাশ উদ্ধারে ঘটনাস্থলে যাওয়া সদর মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান জানান- জেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ওয়াহেদ মিয়ার ছেলে শান্তর স্ত্রী হিসেবেই সাদিয়াকে জানতো সবাই। বিয়ে ছাড়াই ওই বাসায় একত্রে থাকতো তারা। এ দু’জনের মধ্যে কোনো ঘটনা থেকে সাদিয়া আত্মহত্যা করতে পারে- এমনই ধারণা পুলিশের। ছিদ্দিকুর জানান, রনি নামের একজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা গিয়ে দরজা ভেঙে প্রবেশ করে লাশ উদ্ধার করেন। গতকাল  দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালে সাদিয়ার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সাদিয়ার মা সালমা আক্তার মেয়ের আত্মহত্যার কারণ নিয়ে মুখ খুলছেন না। বলেন-আমার ভালো লাগে না। আমি কথা বলতে পারবো না। ২ মেয়ে এক ছেলের মধ্যে সাদিয়া সর্বকনিষ্ঠ জানিয়ে বলেন- এটা ছিল আমার ময়না পাখি। এরপরই কাঁদতে শুরু করেন। সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান জানান- এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে ১৬ই নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে কসবার গোপীনাথপুরে মো. আলমগীর হোসেন (৪৭) নামে এক রাজমিস্ত্রি আত্মহত্যা করে। পুলিশ জানায়- সে মানসিক রোগী ছিল। তার ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। পরিবার নিয়ে কুমিল্লায় থাকতো আলমগীর। কয়েকদিন আগে আলমগীর একা গ্রামের বাড়িতে আসেন। পাশে শ্বশুরবাড়িতে খাওয়া-ধাওয়া করতেন আর নিজ ঘরে রাত্রিযাপন করতেন। ওইদিন রাতের খাবার খেতে না গেলে স্বজনরা তার খোঁজে এসে দেখেন ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে রশি গলায় ঝুলছেন আলমগীর। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানান- মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্যে সুরতহালের পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছেন তারা। এব্যাপারে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ১৪ই নভেম্বর নবীনগরের বিদ্যাকুট ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামে তারাবানু নামে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ওইদিনই দুপরে জেলা শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকায় ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান শেফালী বেগম (২৭) নামের এক গৃহবধূ। এতে তার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রেলওয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় প্রেরণ করে। তার বাড়ি সদরের মাছিহাতা ইউনিয়নের জগৎসার গ্রামে।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।  সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক এই ঘটনা উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২ মাসে আত্মহত্যায় মারা যাওয়া ৪৮ জনের ময়নাতদন্ত হয়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে। তবে হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসক রানা নূর শাম্স বলেছেন- আগের তুলনায় আত্মহত্যা বেড়েছে সেটি মনে হয় না। তার দাবি আগেও এমনই ছিল। বলেন- আমরা বছরে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ ময়নাতদন্ত করি। এগুলো সব আন ন্যাচারাল ডেথ। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি আত্মহত্যা। বিষপানে এবং গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে এখানে। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ১৩/১৪ বছরের বাচ্চাও রয়েছে বলে জানান তিনি।

১০ই নভেম্বর বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের তুলাতুলা গ্রামে আত্মহত্যা করেন আমেনা খাতুন (৩৫) নামের এক গৃহবধূ। ঘরের তীরের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তার ৩টি ছেলে রয়েছে। নাসিরনগরের কুন্ডা ইউনিয়নের কুন্ডা গ্রামের বেড়িবাধে নির্মানাধীন মসজিদের মাচার সাথে লুঙ্গি বেধে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মো: জুবাইদ মিয়া(২০) নামের এক তরুন। তার বাড়ি চাতলপাড়ের কাঁঠালকান্দি গ্রামে। এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৯ই নভেম্বর। আমেনা এবং জুবাইদ মানসিক রোগী ছিল বলে পুলিশ ও তাদের স্বজনরা জানায়। এদিনই কসবা পৌর এলাকার বিশারবাড়ি গ্রামে পারিবারিক কলহে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করে তামান্না আক্তার (২৬) নামের এক গৃহবধূ। দু’সন্তানের মা তামান্না। ১৪ বছর আগে তার বিয়ে হয় বিশারাবাড়ি গ্রামের রঙ্গু মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। অবশ্য তামান্নার স্বজনরা দাবি করেন তাকে হত্যা করা হয়েছে।  যৌতুকের জন্যে স্বামী তাকে নির্যাতন করে আসছিল। এরআগে ৮ই নভেম্বর সরাইল সদরের সাগরদীঘি পাড়ে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করে জুম্মান খাঁ (৩৫) নামে এক মাদকসেবী। জুম্মানের স্ত্রী ইশরাত জাহানও(২৭) মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। একই সঙ্গে থাকলেও তাদের মধ্যে বনিবনা ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে কথাকাটাকাটির জেরে আত্মহত্যা করে জুম্মান। এদিন দুপুরে নাসিরনগরের ফান্তদাউকে শাপলা বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধূ শোবার ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনিও ২ সন্তানের জননী। নাসিরনগরের চাতলপাড়ে অভাব-অনটনে বিপর্যন্ত হয়ে কীটনাশক ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন জিয়াউর রহমান (৪৬) নামের এক ব্যক্তি। গত ৭ই নভেম্বর দুপুরে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। স্ত্রী এবং ৯ ছেলে-মেয়ের সংসারে অভাবে দিশাহারা ছিলেন জিয়াউর। এদিনই আশুগঞ্জের লালপুরের কান্দা গ্রামে ছেলের সঙ্গে অভিমান করে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন আঙ্গুরা বেগম (৫০)। ৭ই নভেম্বর আরও একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে জেলা শহরের গোকর্ণঘাটের দক্ষিণ পাড়ায়। পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ সায়মা জেরিন (৩০)। স্বামী হান্নান মিয়ার অত্যাচার-নির্যাতন সইতে না পেরে জেরিন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান। ১৪ বছর আগে বিয়ে হয় জেরিনের। তার দু’টি সন্তান রয়েছে। ৫ই নভেম্বর সরাইলের চুন্টা ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে কেরির ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে সুমাইয়া আক্তার (১৪) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রী। ৩রা নভেম্বর জেলা শহরের ছয়বাড়িয়া এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আত্মহত্যা করে দুবাই প্রবাসী মোবারক হোসেন। ৭/৮ মাস আগে ওই এলাকার সফর আলীর মেয়ে তানিয়াকে বিয়ে করেন মোবারক। বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে অশান্তি চলছিল। আশুগঞ্জের সোনারামপুরে ১২তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে শিপা আক্তার (১৩) নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। ১লা নভেম্বর পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফসানা হক সাথী (৩৩)। তার দু’টি পুত্রসন্তান রয়েছে। স্বামী ইমরান খান পরনারীতে আসক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন সাথীর বাবা ফজলুল হক। এনিয়ে অশান্তি থেকে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন সাথী। সাথীর লাশ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যায় তার স্বামী সবুজ। এদিনই নবীনগরের বিদ্যাকুট গ্রামে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন সিদ্দিক মিয়া (৪৮) নামের এক ব্যক্তি। স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িত সন্দেহে সংসারে সৃষ্ট অশান্তিতে বিজয়নগরের চম্পকনগরে ১লা নভেম্বর আত্মহত্যা করেন মো. শাওন (২২) নামের এক অটোচালক। ৩১শে অক্টোবর আখাউড়ার দক্ষিণ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে মা-বাবার সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করে নূপুর আক্তার নামে এক কিশোরী। তাকে মোবাইল ফোন চালাতে নিষেধ করেছিলেন বাবা-মা।

জেলার পুলিশ সুপার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন- এখানে যারা আত্মহত্যা করছে তাদের বেশির ভাগ কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করে। সে কারণে আইনশৃঙ্খলা সভায় আত্মহত্যার বিষয়টি আলোচনায় আসার পর কেরির বড়ি যাতে সহজলভ্য না হয়, কোন ফার্মেসিতে যাতে ওপেন বিক্রি না হয়, মানুষ যাতে সহজে না পায় সেটি দেখার জন্যে ড্রাগ অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন-আত্মহত্যা বাড়ার পেছনে একটি কারন হচ্ছে এটি প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা। এসব পরিবারগুলোতে নানা বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে। এছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে।

তবে সচেতন মহল মনে করছে স্মার্ট ফোনের অবাধ ব্যবহারের কারনে বিভিন্ন ভাবে আশক্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে যুব সমাজ। এ বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ।

ট্যাগস :

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতি বছর আত্মহত্যা করছেন আড়াই থেকে তিনশ’ মানুষ অধিকাংশ নারী

আপডেট সময় : ১২:৫০:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

 গত ২ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আত্মহত্যা করেছে ৪৮ জন। তবে  জেলা সদর হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন- আগের তুলনায় এ সংখ্যা বেশি বলা যাবে না। জেলায় প্রতি বছর আড়াই থেকে তিনশ’ লোক আত্মহত্যা করে বলে তথ্য দেন তারা। স্ত্রী বা স্বামীর পরকীয়া সম্পর্ক, মোবাইল ব্যবহারে বাধা, স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক বিরোধ এবং অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাদের অনেকে। আত্মহত্যাকারীদের অধিকাংশ নারী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার (২০) বাসায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। গত শুক্রবার রাত ৮ টার দিকে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।  কসবার কুটি ইউনিয়নের মাইঝখার গ্রামের মোস্তফা কামালের মেয়ে সাদিয়া জেলা শহরের পশ্চিম মেড্ডার সিও অফিস এলাকায় মদিনা টাওয়ার নামীয় একটি বহুতল বাড়ির ৫ তলায় একাই থাকতো।

তবে লাশ উদ্ধারে ঘটনাস্থলে যাওয়া সদর মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান জানান- জেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ওয়াহেদ মিয়ার ছেলে শান্তর স্ত্রী হিসেবেই সাদিয়াকে জানতো সবাই। বিয়ে ছাড়াই ওই বাসায় একত্রে থাকতো তারা। এ দু’জনের মধ্যে কোনো ঘটনা থেকে সাদিয়া আত্মহত্যা করতে পারে- এমনই ধারণা পুলিশের। ছিদ্দিকুর জানান, রনি নামের একজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা গিয়ে দরজা ভেঙে প্রবেশ করে লাশ উদ্ধার করেন। গতকাল  দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালে সাদিয়ার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সাদিয়ার মা সালমা আক্তার মেয়ের আত্মহত্যার কারণ নিয়ে মুখ খুলছেন না। বলেন-আমার ভালো লাগে না। আমি কথা বলতে পারবো না। ২ মেয়ে এক ছেলের মধ্যে সাদিয়া সর্বকনিষ্ঠ জানিয়ে বলেন- এটা ছিল আমার ময়না পাখি। এরপরই কাঁদতে শুরু করেন। সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান জানান- এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে ১৬ই নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে কসবার গোপীনাথপুরে মো. আলমগীর হোসেন (৪৭) নামে এক রাজমিস্ত্রি আত্মহত্যা করে। পুলিশ জানায়- সে মানসিক রোগী ছিল। তার ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। পরিবার নিয়ে কুমিল্লায় থাকতো আলমগীর। কয়েকদিন আগে আলমগীর একা গ্রামের বাড়িতে আসেন। পাশে শ্বশুরবাড়িতে খাওয়া-ধাওয়া করতেন আর নিজ ঘরে রাত্রিযাপন করতেন। ওইদিন রাতের খাবার খেতে না গেলে স্বজনরা তার খোঁজে এসে দেখেন ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে রশি গলায় ঝুলছেন আলমগীর। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানান- মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্যে সুরতহালের পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছেন তারা। এব্যাপারে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ১৪ই নভেম্বর নবীনগরের বিদ্যাকুট ইউনিয়নের মণিপুর গ্রামে তারাবানু নামে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ওইদিনই দুপরে জেলা শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকায় ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান শেফালী বেগম (২৭) নামের এক গৃহবধূ। এতে তার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রেলওয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় প্রেরণ করে। তার বাড়ি সদরের মাছিহাতা ইউনিয়নের জগৎসার গ্রামে।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।  সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক এই ঘটনা উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২ মাসে আত্মহত্যায় মারা যাওয়া ৪৮ জনের ময়নাতদন্ত হয়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে। তবে হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসক রানা নূর শাম্স বলেছেন- আগের তুলনায় আত্মহত্যা বেড়েছে সেটি মনে হয় না। তার দাবি আগেও এমনই ছিল। বলেন- আমরা বছরে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ ময়নাতদন্ত করি। এগুলো সব আন ন্যাচারাল ডেথ। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি আত্মহত্যা। বিষপানে এবং গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে এখানে। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ১৩/১৪ বছরের বাচ্চাও রয়েছে বলে জানান তিনি।

১০ই নভেম্বর বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের তুলাতুলা গ্রামে আত্মহত্যা করেন আমেনা খাতুন (৩৫) নামের এক গৃহবধূ। ঘরের তীরের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তার ৩টি ছেলে রয়েছে। নাসিরনগরের কুন্ডা ইউনিয়নের কুন্ডা গ্রামের বেড়িবাধে নির্মানাধীন মসজিদের মাচার সাথে লুঙ্গি বেধে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মো: জুবাইদ মিয়া(২০) নামের এক তরুন। তার বাড়ি চাতলপাড়ের কাঁঠালকান্দি গ্রামে। এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৯ই নভেম্বর। আমেনা এবং জুবাইদ মানসিক রোগী ছিল বলে পুলিশ ও তাদের স্বজনরা জানায়। এদিনই কসবা পৌর এলাকার বিশারবাড়ি গ্রামে পারিবারিক কলহে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করে তামান্না আক্তার (২৬) নামের এক গৃহবধূ। দু’সন্তানের মা তামান্না। ১৪ বছর আগে তার বিয়ে হয় বিশারাবাড়ি গ্রামের রঙ্গু মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। অবশ্য তামান্নার স্বজনরা দাবি করেন তাকে হত্যা করা হয়েছে।  যৌতুকের জন্যে স্বামী তাকে নির্যাতন করে আসছিল। এরআগে ৮ই নভেম্বর সরাইল সদরের সাগরদীঘি পাড়ে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করে জুম্মান খাঁ (৩৫) নামে এক মাদকসেবী। জুম্মানের স্ত্রী ইশরাত জাহানও(২৭) মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। একই সঙ্গে থাকলেও তাদের মধ্যে বনিবনা ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে কথাকাটাকাটির জেরে আত্মহত্যা করে জুম্মান। এদিন দুপুরে নাসিরনগরের ফান্তদাউকে শাপলা বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধূ শোবার ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনিও ২ সন্তানের জননী। নাসিরনগরের চাতলপাড়ে অভাব-অনটনে বিপর্যন্ত হয়ে কীটনাশক ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন জিয়াউর রহমান (৪৬) নামের এক ব্যক্তি। গত ৭ই নভেম্বর দুপুরে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। স্ত্রী এবং ৯ ছেলে-মেয়ের সংসারে অভাবে দিশাহারা ছিলেন জিয়াউর। এদিনই আশুগঞ্জের লালপুরের কান্দা গ্রামে ছেলের সঙ্গে অভিমান করে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন আঙ্গুরা বেগম (৫০)। ৭ই নভেম্বর আরও একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে জেলা শহরের গোকর্ণঘাটের দক্ষিণ পাড়ায়। পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ সায়মা জেরিন (৩০)। স্বামী হান্নান মিয়ার অত্যাচার-নির্যাতন সইতে না পেরে জেরিন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান। ১৪ বছর আগে বিয়ে হয় জেরিনের। তার দু’টি সন্তান রয়েছে। ৫ই নভেম্বর সরাইলের চুন্টা ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে কেরির ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে সুমাইয়া আক্তার (১৪) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রী। ৩রা নভেম্বর জেলা শহরের ছয়বাড়িয়া এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আত্মহত্যা করে দুবাই প্রবাসী মোবারক হোসেন। ৭/৮ মাস আগে ওই এলাকার সফর আলীর মেয়ে তানিয়াকে বিয়ে করেন মোবারক। বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে অশান্তি চলছিল। আশুগঞ্জের সোনারামপুরে ১২তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে শিপা আক্তার (১৩) নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। ১লা নভেম্বর পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফসানা হক সাথী (৩৩)। তার দু’টি পুত্রসন্তান রয়েছে। স্বামী ইমরান খান পরনারীতে আসক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন সাথীর বাবা ফজলুল হক। এনিয়ে অশান্তি থেকে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন সাথী। সাথীর লাশ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যায় তার স্বামী সবুজ। এদিনই নবীনগরের বিদ্যাকুট গ্রামে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন সিদ্দিক মিয়া (৪৮) নামের এক ব্যক্তি। স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িত সন্দেহে সংসারে সৃষ্ট অশান্তিতে বিজয়নগরের চম্পকনগরে ১লা নভেম্বর আত্মহত্যা করেন মো. শাওন (২২) নামের এক অটোচালক। ৩১শে অক্টোবর আখাউড়ার দক্ষিণ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে মা-বাবার সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করে নূপুর আক্তার নামে এক কিশোরী। তাকে মোবাইল ফোন চালাতে নিষেধ করেছিলেন বাবা-মা।

জেলার পুলিশ সুপার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন- এখানে যারা আত্মহত্যা করছে তাদের বেশির ভাগ কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করে। সে কারণে আইনশৃঙ্খলা সভায় আত্মহত্যার বিষয়টি আলোচনায় আসার পর কেরির বড়ি যাতে সহজলভ্য না হয়, কোন ফার্মেসিতে যাতে ওপেন বিক্রি না হয়, মানুষ যাতে সহজে না পায় সেটি দেখার জন্যে ড্রাগ অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন-আত্মহত্যা বাড়ার পেছনে একটি কারন হচ্ছে এটি প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা। এসব পরিবারগুলোতে নানা বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে। এছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে।

তবে সচেতন মহল মনে করছে স্মার্ট ফোনের অবাধ ব্যবহারের কারনে বিভিন্ন ভাবে আশক্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে যুব সমাজ। এ বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ।