আদর্শবান সাংবাদিকের বদলে দুস্থ সাংবাদিক তৈরীতে ব্যস্ত সবাই!
সব মাছ গু খায়, নাম পড়ে ঘাউরা মাছের। ছোটবেলার এ কথাটি বার বার মনে পড়ছে। দুর্ণীতিতে চ্যাম্পিয়ন দেশে সব দোষ না কি শুধু সাংবাদিকদের!
সবাই সাংবাদিকদের এখন হলুদ সানগ্লাস দিয়েই দেখতে শুরু করেছেন। চারদিকে সবাই ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ই কেবল দেখছেন। সাংবাদিকরা যে জাতির বিবেক, হলুদ সূর্য্যালোকের মতোই দেশকে আলোকিত করেন সেটা ভুলে যাচ্ছেন সবাই। তবে এজন্য সমসাময়িক সাংবাদিকরাও কমবেশী দায়ী। কিছু কিছু সাংবাদিক সরকারের গুণগানে এতোই মশগুল যে, তাদের লেখা, রিপোর্ট, আলোচনা ও বক্তব্য এখন আর কারো মনোযোগ আকর্ষণ করে না। সবাই বুঝে যান উনি কোন ঘরানার লোক। সবার গায়েই দলীয় ট্যাগ লাগানো। নিরপেক্ষ বলে এখন আর কেউ নেই। জাতীয় সংসদে সরকার যেরকম গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরী করেছে দিনের পর দিন, ঠিক সেরকম কিছু গৃহপালিত সাংবাদিকও এদেশে তৈরী হয়েছে সরকার ও আমলাদের উদ্যোগে।
এখন দেশের সব মিডিয়ায় সব এক দলের এক পক্ষের নিউজ। প্রেসরিলিজ সর্বস্ব নিউজ অনেকটা। ডিজিটাল যুগে টাকা পয়সা দিয়ে পত্রিকা কেনার লোকও কমে যাচ্ছে দিনদিন। নগদ অর্থে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা কিনতে গিয়েও হিমসিম খেতে হচ্ছে। সংবাদপত্রের হকাররা আজ নিয়মিত পত্রিকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে চান না। দুই দিন পত্রিকা দেন তো একদিন ‘গ্যাপ’ দেন। অনিয়মিত পত্রিকা পেয়ে পাঠক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ১২ টাকা দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা কিনলেও সেটি পড়ার মতো আগ্রহী লোকের অভাব প্রতিটি পরিবারে। আগের মতো পত্রিকা পড়া নিয়ে টানহেচড়া আর হয় না ভাই বোনদের মধ্যে। সবাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও নিজ নিজ মোবাইলেই সব কাজ সারছেন। কেউ কি বলতে পারবেন- এ দেশে কয়জন সাংবাদিক সরকারী চাকুরী করেন? কত পার্সেন্ট সংবাদকর্মী সরকারী সুযোগ সুবিধা নেন। এদেশে ৯৯% সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়া হাউজ বেসরকারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। এটা ঠিক সবসময়ই সরকার দলীয় লোকজন এই শিল্প ও খাতটিকে নিয়ন্ত্রন করেন।
বেশিরভাগ মালিকানাও তাদের হাতেই থাকে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়াগুলোতে প্রায় সময়ই বেতন নিয়মিত নয়। সরকার ঘোষিত ওয়েজবোর্ডে বেতন দেয়া হয় হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্রে। প্রিন্ট মিডিয়ায় এটা চালু হলেও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এখনো তা অনুপস্থিত। গার্মেন্টস শ্রমিক সহ অন্যদের সুযোগ সুবিধা বেতন ভাতা নিয়ে সাংবাদিকরা নিয়মিত লেখালেখি করলেও নিজেদের সমস্যায় তারা সেরকম কিছুই লিখতে পারেননা। হয়তো ব্যক্তিগত লজ্জায়, নয়তো পেশার মানসম্মানের কথা চিন্তা করে। করোনার পর অনেক সাংবাদিকই চাকুরী ও কাজ হারিয়েছেন। অনেক সংবাদমাধ্যমই বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেদের বেকার বলতে আত্মসম্মানে বাঁধে সাংবাদিকদের। সেজন্য মরিয়া হয়ে চাকুরীও খুঁজতে পারেন না। অপেক্ষায় থাকেন হয়তো কেউ চাকুরীর অফার নিয়ে এগিয়ে আসবে। হয়তো তার কোয়ালিটি ও দক্ষতার কথা ভেবে কেউ আগ্রহ দেখাবে। সেটা না হলে সৃষ্টিকর্তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হন এ কথা ভেবে যে- ‘রিজিকের মালিক আল্লাহ।’ এসব কারণে সরকার ঘোষিত সুবিধা নিতেও ইচ্ছুক নয় অনেক সাংবাদিক। করোনা মহামারীর সময় এরকম প্রণোদনার সুযোগ পেয়েও অনেক বেকার সাংবাদিক সরকারের সে সুবিধা নেননি। সাংবাদিকতা করার সুস্থ্য পরিবেশ না থাকায় অনেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন এ পেশা থেকে। চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। শখের সাংবাদিকতা নেশা হলেও এখন পেশা হতে পারছে না। তরুণ বয়সের উচ্ছ্বল সাংবাদিকটি সমাজ সংসারের কথা ভেবে নিজেকে পরিনত বয়সে অন্য পেশায় আবিস্কার করছেন। এরই মাঝে সরকার নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সাংবাদিকদের মধ্যে কিছু গৃহপালিত নেতা ও দালাল তৈরী করছে। দুস্থ সাংবাদিকদের কথা বলে কোটি কোটি টাকার সরকারী অনুদান তুলে নিচ্ছেন সে নেতারা। আজ্ঞাবহ সাংবাদিক নামধারী কিছু দলীয় কর্মীকে সে অর্থ গছিয়ে দিয়ে নিজেদের গদি ঠিক রাখবে মিডিয়ার এই বুদ্ধিজীবিরা। বিপরীতে এই প্রতিদানের ফসল ঘরে তুলবে সরকার! সাংবাদিকতা মহান পেশা। জেষ্ঠ্য সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ মৃত্যুর আগে এ কথাটি প্রায়সময়ই বলতেন। তরুন বয়সে তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হতাম। নীতি, আদর্শ আর ঐতিহ্যের জন্য এ পেশাটি একসময় সবার কাছে সম্মানিত ছিল। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এখন প্রেক্ষাপট পাল্টেছে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে উচিত কথা বলার মতো সাংবাদিকের সংখ্যা দিন দিনই কমছে। সংবাদপত্র, মিডিয়া ও সাংবাদিকদের নিয়ে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন আইন তৈরী হওয়ায় সাংবাদিকরা আর আগের মতো স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না। অনেকেই সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেন নিজের ওপর নিরাপত্তার কথা ভেবে। চাকুরী করা বেতনধারী আদর্শবান সাংবাদিকের চেয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এখন যেন দুস্থ সাংবাদিকের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। আর সেটা দেখে বাড়ছে আমাদের দীর্ঘশ্বাসও !
ইমরুল সুমন
তারিখ: ১৫/১১/২০২৩ খ্রিস্টাব্দ সময়: দুপুর ১২:৪৫ টা মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট