ভাণ্ডারিয়ায় ১০ টাকা সঞ্চয়ে সূর্যমুখী তৈল উৎপাদন: গ্রামের কৃষকদের রুচি পাল্টে দিছেআমাদের পথচলা সংগঠন
মামুন হোসেন ভাণ্ডারিয়া ,পিরোজপুর
গ্রামের নিম্ন আয়ের লোকদের নিয়ে ভেজাল মুক্ত সূর্যমুখী চাষ করে তা থেকে তৈল উৎপাদন করে সফল হয়েছেন ‘আমাদের পথচলা’ নামক একটি পল্লী সংগঠন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগীতা পেলে আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে দেশ বিদেশে বিষমুক্ত খাটি তৈল সরবারহ দিতে পারবে বলে সংগঠনের উদ্যোক্তারা জানান। রবিবার সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানা গেছে, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ভিটাবাড়িয়া
ইউনিয়নের উত্তর শিয়ালকাঠী প্রত্যান্ত গ্রামের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময় সহ
বিভিন্ন সময় গ্রামের কৃষকদের ও বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষের দেহে নানা রোগ ব্যাধিতে দেখা দিচ্ছে। ঠিক তখনই এলাকার ভাণ্ডারিয়া
ফ্রেন্স মেডিকেল হলের পরিচালক শিক্ষিত যুবক রফিকুল ইসলাম মিলন সিকদার চিন্তায় পড়ে যায়। তিনি চিন্তা ও গবেষণা করে দেখেন ভ্যাজাল তৈল সেবনের জন্যই এই নানান রোগ দেখা দিচ্ছে। তাই তিনি ২০২১ সালে এলাকার কৃষকদের নিয়ে গঠন করে ‘আমাদের পথচলা’ নামক সংগঠন। উদ্যোগ নেন কৃষকদের থেকে দৈনিক ১০ টাকা সঞ্চয় নিয়ে খাটি তৈল সরবারহের। শুরু করেন সূর্যমুখী ও শরিষার চাষ । সেই ফসলের বীজ দিয়ে নিজস্ব মেশিনে খাটি তৈল উৎপাদন করে সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিক্রি করেন তিনি। বর্তমানে এ সংগঠনের দেড়শত সদস্যদের সঞ্চয় দাড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। তিনি আরো জানান, প্রথম দিনই ৮০ জন কৃষক সদস্য হন। পরে তারা দৈনিক ১০ টাকা সঞ্চয় শুরু করেন।
সঞ্চয়ের সেই টাকায় ২০২২ সালের শুরুর দিকে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি বীজ ভাঙ্গার মেশিন ক্রয় করেন। ওই বছরই ২০ মন সরিষা কিনে তৈরি করেন খাঁটি সরিষার তৈল এবং এ বছর নিজ গ্রামের ৬ হেক্টর জমিতে প্রায় আড়াইলাখ টাকা ব্যয়ে সূর্যমুখীর চাষ করে প্রায়
১শ মন বীজ উৎপাদন করে কৃষকরা। তা নিজস্ব মেশিনে মাধ্যমে ভেঙে খাঁটি সূর্যমুখী তৈল সাথে সরিষার তৈল উৎপাদন করা হয়। সেই খাঁটি
সরিষার তৈল ৩২০ টাকা কেজি দামে আর খাটি সূর্যমুখী তৈল ৩৫০ টাকা কেজি দামে সংগঠনের সদস্যদের মাঝে বিক্রি হচ্ছে। ওই তৈল
দিয়ে গ্রামের সবাই এখন নিত্য প্রয়োজনিয় রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন। এছাড়াও সূর্যমুখী ও সরিষার উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে গো খাদ্য
খৈল তৈরি এবং কৃষি পণ্যতে ব্যবহার করেন এলাকার চাষিরা। ভারতের জীবনধারা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বোল্ডস্কাই এক প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, হাজারো রোগের মহৌষধ সূর্যমুখী তৈল। সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। মিষ্টি বাদাম জাতীয় এই বীজে রয়েছে প্রচুর
স্বাস্থ্য উপাদান। এতে খনিজ পদার্থ, ভিটামিন এ,ডি ও ই ও প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড রয়েছে। সূর্যমুখীর বীজ শরীরের নানা রোগ সারিয়ে তোলে ও নানাভাবে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। ১৯৭৫ সাল থেকে সূর্যমুখী একটি তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে চাষাবাদ হচ্ছে। তেলের উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়। এই তৈল অন্যান্য রান্নার তেলের চেয়ে ভালো। এতে কোলেস্টেরলের মাত্রা অত্যন্ত কম থাকায় হৃদরোগীর জন্য বেশ কার্যকর। গবেষনার আরো জানা যায়, সূর্যমুখীর বীজে রয়েছে উন্নতমানের ভিটামিন ই যা অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। নিয়মিত এটি খেলে অস্টিওআর্থারাইটিস, অ্যাজমা ও বাতরোগ নিরাময় হয়। হাড়ের সুস্থতার জন্য ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালশিয়াম দুটোই খুব জরুরি। সূর্যমুখীর বীজ খনিজ পদার্থের খুব ভালো উৎস, তাই এটি সুস্থ হাড় গঠনে সহায়তা করে। সূর্যমুখীর বীজে তৈলে আছে উচ্চমানের ফাইটোস্টেরল ও লিগন্যানস যা ক্যান্সার কোষ প্রতিরোধ করে। সূর্যমুখীর বীজে রয়েছে ভিটামিন বি-৬ যা মাথার ত্বকে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এতে করে চুল পড়া কমে ও স্বাস্থ্য উজ্জ্বল নতুন চুল জন্মায়। এতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম শরীরের অতিরিক্ত ক্যালশিয়ামের মাত্রা কমিয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করাতে সাহায্য করে। এই বীজ আমাদের দেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল দূর করে আমাদের হৃদন্ডিকে ভালো রাখে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে জনা যায়, প্রতিবছর বিশে^র প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল দূষিত খাদ্য গ্রহণে অসুস্থ হয়। এই অসুস্থ মানুষদের মাঝে ভেজাল খাদ্যের কারণে মারা যায় প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৪৩ শতাংশ শিশু আক্রান্ত হয়। যাদের মধ্যে মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক
গবেষণা ্রপ্রতিবেদন বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতিবছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যানসারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েরা জন্মদান করেন প্রায় ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশু। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে
হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। দেশে নিম্নমানের ভোজ্য তৈলে বাজারে ছয়লাভ। ভেজাল সয়াবিন
ও পাম অয়েল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। যা চোখে জ্বালা, নাকে শুষ্কতা ও প্রদাহ তৈরি সহ ফুসফুস ও লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল ও মানহীন ভোজ্য তেলের নিয়মিত ব্যবহার জনসাধারণের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। উত্তর শিয়ালকাঠী গ্রামের কৃষক নাসির হাওলাদার বলেন, ‘রফিকুল ইসলাম মিলনের চিন্তা ছিল কীভাবে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি করা যায়। ২০২১ সালের শুরুতে মিজান মার্কেট নামক স্থানে তিনি সহ গ্রামের কয়েকজন কৃষকদের নিয়ে এক সভায় মিলিত হন। সভায় জরুরি ভিত্তিতে গ্রামের কৃষকদের ডাকা হয়। সকলের সমর্থনে সেদিন গঠন করা হয়েছিলো আমাদের পথচলা সংগঠনটি। সুস্বাস্থ্য ও আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘আমাদের পথচলা’ নামক এই সংগঠন। কৃষক শহিদুল শিকদার বলেন, ‘মিলন সিকদারের হাত ধরে এলাকার কৃষকদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। ভেজাল মুক্ত তৈল উপহার দিয়ে কৃষকদের মাঝে অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আমাদের পথচলার সফলতা দেখে গ্রামের তরুণ ও যুবকরা কৃষি কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন। সংগঠনের পরামর্শ পেয়ে অনেক
কৃষক ঘুরে দাড়িয়েছে। আজ সোমবার ‘আমাদের পথচলা’ সংগঠনের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম মিলন সিকদার বলেন, ‘আমার পেশা ওষুদের
ব্যবসা। আমি ছোট বেলা থেকেই কৃষি নিয়ে কাজ করি। কৃষকদের পাশে থাকতে এবং তাদের সঙ্গে কাজ করতে সংগঠনটি গঠন করেছি।
আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যগুলো বিষমুক্ত। এই সংগঠনের মাধ্যমে সকল মানুষকে সুস্থ্য জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। সরকারি সহযোগীতা
পেলে আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে দেশ বিদেশে ভেজাল মুক্ত তৈল উপহার দিতে পারবো বলে তিনি জানান। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নজরু ইসলাম বলেন, ‘ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় সূর্যমুখী চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য ফসলের তুলনায় এটা খুব লাভজনক। আমাদের পথচলা সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকেরা ১০ টাকা সঞ্চয় করে ৬ একর জমিতে সূর্যমূখীর চাষ করেছে খাটি তৈল উৎপাদন করছে। এটা একটি ভালো উদ্যোগ। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।