সুন্দরবন উপকূলীয় উপজেলা কয়রার সরকারী খালগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও নেট-পাটা বসানোর ফলে পানি প্রবাহে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে দুষণের পাশাপাশি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলাবদ্ধতা ও খরায় এলাকার জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। ভরাটকৃত খালের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। উপকূলের সম্ভবনাময় কৃষি অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ছে। পাঁচ হাজার বিঘা জমির আমন চাষ অনিশ্চয়তায় রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে খরা, ভূ-গর্ভে পানির স্তর ক্রমে নীচে নেমে যাওয়াসহ আরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ শাকবাড়িয়া খালের পশ্চিম খন্ড কপোতাক্ষ নদের হোগলা ও পূর্ব খন্ড শাকবাড়িয়া নদীর সুতির অফিস নামক স্থানে মিলেছে। খালটি মাছ চাষের জন্য বাঁধ ও নেট-পাটা দিয়ে দশ খন্ডে ভাগ করা হয়েছে। এ সময় এই খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। এখন সরু ক্যানেলে পরিণত হয়েছে। ভরাট হওয়া স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। নানা ধরণের বর্জ্য ফেলায় দুষিত হচ্ছে পানি। ফলে অন্তাবুনিয়া, শ্রীরামপুর, চর কালনা, মহারাজপুর, মঠবাড়ী ও বড় বিল নামক বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। খালের মাঝ দিয়ে অন্তাবুনিয়া নামক স্থানে কয়রা-পাইকগাছা প্রধান সড়ক নির্মাণ ও বালু ভরাট করে মাঠ তৈরি করায় পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বেড়ের খাল শাকবাড়িয়ার দেয়াড়া নামক স্থানে মিশেছে। বেড়ের খালের পানি সরবরাহের জন্য শাকবাড়িয়ার পশ্চিম মাথা হোগলায় স্লুইসগেট জরুরি। মাদারবাড়ি, লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিলের পানি নিষ্কাশনে বেড়ের খাল অন্যতম পথ। বেড়ের খালেও রয়েছে ৪টি বাঁধ ও পাটা। জলাবদ্ধতায় মাদারবাড়ি, লখ্নীখোলা, দক্ষিণ দেয়াড়া বিলের অধিকাংশ জমিতে আমন চাষ হচ্ছে না। মাদারবাড়িয়ার অংশে মিষ্টি পানি থাকলেও দেয়াড়ার অংশে ইজারা নিয়ে নোনা পানিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পলি জমে ও আবর্জনা ফেলায় এটিও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
তিন কিলোমিটার দীর্ঘ আমতলা খাল গিলাবাড়ি গ্রাম থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ মহেশ্বরীপুরের নয়ানি স্লুইসগেটে গিয়ে মিশেছে। খালের দুই স্থানে বাঁধ দিয়ে ও ৮টি স্থানে নেট-পাটা বসিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
শুধু তিনটি খাল নয়, দেউলিয়া, ছোট দেউলিয়া, অর্জুনি, দরগাবাড়ীয়া, কাশির খাল, পাটকেলখালী, চন্ডিপুর জলকর, সুড়িখালী, হলুদবুনিয়াসহ অর্ধশতাধিক খালে বাঁধ ও নেট-পাটা দেওয়ায় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। আমুরকাটা, বালিয়াডাঙ্গা জলকর, সীমানার খাল ও বারইখালী খাল সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে। মহারাজপুরের শাকবাড়িয়া পূর্বখন্ড, শাকবাড়িয়ার পশ্চিম খন্ড, কইখালী, পূর্ব খাল, পশ্চিম খাল, মঠের খাল, আমাদীর ইষ্ট সাউথ জলকর, ক্ষিরোল মৌজা জলকর, সদর ইউনিয়নের বজবজিয়া, তাসখালী, দরগাবাড়িয়া, মহেশ্বরীপুরের পাটকেলখালী এবং বেদকাশির কাটাখালী, চড়ামুখা, কাশিরখাল গোড়ার খন্ড ও জোড়শিং খালের অধিকাংশ ভরাট হয়ে গেছে। ভরাটকৃত অধিকাংশ খালের জায়গা অবৈধ দখলদারদের কবলে। কিছু স্থানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। স্লুইস গেটগুলো নষ্ট অবস্থায়। কয়েকটি খালের মাথায় স্লুইস গেট না থাকায় পানি সরাতে গেলে উল্টে নোনা পানি ঢুকে পড়ছে।
কালনা গ্রামের কৃষক ইয়াসিন বলেন, সময়মতো পানি নিষ্কাশন করতে না পারায় আমন উৎপাদন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। শাকবাড়িয়ার খালের পাড়ে বসতবাড়ি গড়ে উঠায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। মাদারবাড়িয়া বিলের কৃষক আব্দুল হাই জানান, গত বছর তিন বিঘা জমি চাষে ২৫ হাজার টাকা খরচ করে ১২ মণ ধান পান। এবছর কৃষি অফিস থেকে বীজ পেয়েও জলাবদ্ধতার কারণে বীজতলা করতে পারেননি। ধানের চারা কিনে রোপন করতে হচ্ছে।
বামিয়া বিলের কৃষক রফিকুল বলেন, খাল ইজারা দেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানি কিনে তরমুজ চাষ করতে হয়। এরপরেও প্রয়োজন অনুযায়ী খালের পানি দিতে চান না ইজারাদাররা।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্র জানায়, উপজেলায় ২০ একরের নিচে ৯৯টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ৫৫টি খাল ৪১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩০ টাকায় ইজারা দেয়া রয়েছে। ১২টি খালে মামলা চলমান থাকায় ইজারা বন্ধ ও তিনটি খালের ইজারা স্থগিত রয়েছে । ১৭টি খাল থেকে খাস আদায় করা হয়। ৪টি খাল সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামাল বলেন, যে কোন খাল, দখল বা দুষণের শিকার হলে এক সময় তা ভরাট হয়ে সংলগ্ন এলাকায় বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও শীতের সময় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে সংকট তৈরী করে। খালের ব্যাপ্তি অনুযায়ী কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি এর দখল সংযুক্ত নদী বা বিলের মৃত্যু ঘটায়। যা স্থানীয় জলপথে যোগাযোগ ও মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মমিনুর রহমান বলেন, খালে কোন অবস্থাতে বাঁধ কিংবা নেট-পাটা দিয়ে পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ নেই। শুষ্ক মৌসূমে কৃষকদের চাষাবাদের জন্য অবাধে মিষ্টি পানি সরবরাহ বাড়াতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা উপকূলেঃ লবনাক্ত উপকূলে আমন-বোরো আবাদের পাশাপাশি উৎপাদিত হচ্ছে সিজনাল ও অফসিজন তরমুজ, গম, ভুট্টা, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, বিভিন্ন ধরণের সবজিসহ নানা প্রজাতির ফসল। খাল খননের মাধ্যমে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ ও অবাধ ব্যবহারের সুযোগ পেলে সবুজ ফসলে ভরে উঠবে উপকূল। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ উপজেলার এক হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে ২১ হাজার ৫৮৭ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়। আর ৮৯৫ হেক্টর জমিতে ৩১ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়। ২০২২ – ২৩ অর্থবছরে এক হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে ২৪ হাজার ২৬৯ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয়। আর এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ৪৪ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়।
সম্ভাব্য ফসল আবাদ নিয়ে কয়রা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৯টি খাল নিয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়রার ৩৯ টি খালে নোনা পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে খাল সংশ্লিষ্ট সাত হাজার দুই হেক্টর জমিতে বছরে ৩৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। ৩৯ টি খালের মোট দৈর্ঘ্য ৫৮ কিলোমিটার। খালগুলোর মধ্যে ১৮ টি খাল ১০ লাখ ৮২ হাজার ৬২৫ টাকায় ইজারা দেওয়া রয়েছে। এছাড়া কৃষি দপ্তর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইসগেট নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ওই প্রতিবেদনে কয়রার ২০ টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৬ সম্পূর্ণ অকেজো ও ১৪ টি সংস্কারযোগ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া হোগলা, বীণাপানী, খিরোল ও নাকশাতে নতুন ৪টি স্লুইসগেট নির্মাণের সুপারিশ করেছে।
কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাস বলেন, কয়েকটি বিলে বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে এবং আমন রোপন বিলম্বিত হচ্ছে। সমস্যা নিরসনে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। তবে খাল খনন ও স্লুইসগেট সংস্কার এর স্থায়ী সমাধান। মাঠে ও ঘেরের পাড়ে লাভজনকভাবে ধান, সবজি ও মাছের সমন্বিত ফসল নিতে লবন পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ প্রয়োজন। তিনি বলেন, খাল খনন, স্লুইসগেট নির্মাণ ও সংস্কার, লবন পানি উত্তোলন বন্ধ করলে কয়েকশত কোটি টাকার বাড়তি ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে এবং অনেক জমি নতুনকরে ফসলের আওতায় আসবে। অনেক এক ফসলী জমি দুই কিংবা তিন ফসলী, দুই ফসলী জমি তিন কিংবা চার ফসলী জমিতে পরিণত হবে এবং শস্য নিবিড়তা বেড়ে যাবে।
শিরোনাম
সুন্দরবন উপকূলের সরকারি খালে বাঁধ ও নেট-পাটা : পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত, জীববৈচিত্রে নেতিবাচক প্রভাব
-
সবুজ বাংলা - আপডেট সময় : ০৬:১১:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অক্টোবর ২০২৩
- ।
- 105
জনপ্রিয় সংবাদ


























