স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার তুলনা করতে গেলে অনেক প্রশ্নই আসতে পারে। রাজনীতিতে কে কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন তার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করার সময় হয়তো এখনো আসেনি; তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, রাজনীতিতে শেখ হাসিনার চেয়ে খালেদা জিয়া ভালো করেছেন।
ইতিহাস সূত্রে, রাজনৈতিক জীবনে দেড় বছরের মতো গৃহবন্দি ও কারান্তরীণ ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করেন তিনি। খুনি ও স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে বর্তমানে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে কারা ও গৃহবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন প্রায় সাড়ে ছয় বছর। দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় স্বৈরশাসকের ভূমিকায় থাকা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরদিনই রাষ্ট্রপতির আদেশে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার শাস্তি মওকুফ ও মুক্তির ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাড়ে ছয় বছর জেল খাটলেও রাজনৈতিক জীবনে জয়ী হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। অন্যদিকে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা দেশ থেকে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যাওয়ায় তিনি রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি পরাস্ত ও পরাজিত হয়েছেন। শেখ হাসিনা শুধু পরাজিতই হননি, তার শাসনামলে মন্ত্রী-এমপি, ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশসহ নিজ দল আওয়ামী লীগ ও দলের নেতাকর্মীদেরও চরম বিপদে ফেলেছেন। তিনি পালিয়ে না গিয়ে জেলে ঢুকলে বরং তার নিজের ও দলের জন্য মঙ্গল হতো। মামলায় আটক হয়ে জেলে গেলে দেশে থেকেই আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন। তার মন্ত্রী-এমপিসহ দলের নেতাকর্মীরাও সাহস পেতেন; আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। অন্যায়-অবিচার ও দুঃশাসনের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আমলে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হবে এটিই স্বাভাবিক। যেমন চলতি মাসের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৯০টির বেশি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৫টি ও ঢাকার নিম্ন আদালতে ৩৫টি হত্যা মামলা হয়েছে বলে প্রসিকিউশন বিভাগ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে। এসব মামলায় সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বিভিন্ন নেতাও এসব মামলায় আসামি হয়েছেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৯০টি হত্যা মামলার মধ্যে গণহত্যা ও অপহরণ এবং হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাতটি মামলা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার বিরুদ্ধে এতোসব মামলার বিবেচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামল এবং পরবর্তী তার বিরুদ্ধে কোনো হত্যা মামলা হয়নি।
বিশেষ করে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে অন্তরীণ করা হয় সংসদ ভবনের কাছে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে। এর প্রতিবাদে তখন বিবৃতি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। সে সময় অস্থায়ী জামিনে ১১ জুন তাকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনুমতি দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকেও আটক করে। সংসদ ভবনের পাশে আরেকটি কারাগারে অন্তরীণ করা হয় তাকে। একই সঙ্গে কারাগারে আটক করা হয় খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে। ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার খালেদা জিয়াকেও বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সে সময় কারাবন্দি জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও তখন এক বছরের বেশি সময় পর সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে কারামুক্তি ঘটে খালেদা জিয়ার। দেশের মাটির প্রতি খালেদা জিয়ার সেই অকৃত্রিম ভালোবাসায় তার দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে দেশনেত্রী তমকা দেন।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি বা চাঁদাবাজির ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও নয়টি দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত নয়টি মামলা হাইকোর্ট থেকে বাতিল বা খারিজ হয়ে যায়। এর পাশাপাশি চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কিত চার মামলায় বাদীরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও দুই মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তার সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা প্রদান করা হয়। প্রথমে তাকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। পরে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। সে সময় তার স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতির কথা উল্লেখ করে পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকবার জামিন চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই নাকচ করে দেওয়া হয়। দুই বছর এক মাস সাজা ভোগের পর ২০২০ সালের মার্চে শর্তযুক্ত মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এ সময়ে তাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ ও বিদেশ যেতে না পারার শর্ত দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস অন্তর আবেদনের পর এ শর্তযুক্ত মুক্তির মেয়াদ বাড়ায় সরকার। অবশেষে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে গত ৬ আগস্ট পুরোপুরি মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দলের প্রধানের মুক্তিতে ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপির কর্মীদের মধ্যে এখন বেশ চাঙাভাব। খালেদা জিয়ার মুক্তির পরদিন ৭ আগস্টই এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। জেলমুক্ত খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে দলটি। দীর্ঘদিন আটক থাকা নেতাকর্মীরা ছাড়া পেয়ে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হয়েছেন।
অন্যদিকে আকস্মিক ক্ষমতাচ্যুতি ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগে আওয়ামী লীগ গহিন সাগরে নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা। বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরতে দেশে নেই শেখ হাসিনা। দলটির কেন্দ্রীয় ও সিনিয়র নেতারাও আত্মগোপনে। পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় রাজনীতির ময়দানে সংগঠিত হতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতেও দলটির নেতাকর্মীদের তেমন কোনো কর্মসূচির আয়োজন করতে দেখা যায়নি। দলটির কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকেও সেখানে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কিছু মানুষ জড়ো হলেও সেখানে আগে থেকে উপস্থিত অনেকের বাধার মুখে তারাও শোক জানাতে পারেননি। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ এখন একপ্রকার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে। শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতার কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল পাসপোর্ট) বাতিল করা হয়েছে। এই অবস্থায় ভারতেও শেখ হাসিনার অবস্থান অনিশ্চিত হতে পারে। এসব বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তটি ছিল একপ্রকার রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। দেশে থেকেই তিনি যদি কারাবরণও করতেন, তাকে মুক্তির দাবি তুলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামার সুযোগ ছিল। দলের নেতাকর্মীদের কাছেও বার্তা যেত যে, কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদের ত্যাগ করেননি তাদের দলের সভানেত্রী। কিন্তু তার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তে তারা এখন পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদেরও বড় অংশের আস্থা হারিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের সংকট সামনের দিনগুলোতে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রাজনীতিতে দলটির প্রত্যাবর্তনকে আরও কঠিন করে তুলবে শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া স্বৈরশাসকের তকমা।
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক সবুজ বাংলা।















