ভূমিকম্প আতঙ্ক পেয়ে বসেছে আমাদের। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে কি করতে হবে এ নিয়ে চিন্তিত সবাই। বাংলাদেশে আমরা যারা থাকি তাদের খুব কম সংখ্যক লোকেরই ভূমিকম্প বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। এতদিন ভূমিকম্প নিয়ে এদেশের মানুষ খুব একটা ভাবেনি। তাদের ধারণা ছিল এশিয়ার জাপান, চীন অথবা ইউরোপ, আমেরিকার কিছু দেশে হয়তো ভূমিকম্প হয়, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়। নেপাল, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভারতের পর বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ভূ-কম্পন নতুন করে চিন্তা ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। আগামীতে ভূমিকম্প হতে রক্ষা পেতে আমাদের কি করতে হবে, কিভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে সে বিষয়ে দেশবাসীকে সচেতন করতে “ওয়ার্ল্ড ওয়াচ সোসাইটি” এর পক্ষ থেকে গত শহিদ বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবসে গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার রাজধানী ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (ভিআইপি লাউঞ্জ) মিলনায়তনে “ভূমিকম্প : সচেতনতা ও আমাদের করনীয়” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। “ওয়ার্ল্ড ওয়াচ সোসাইটি” এর চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফর রহমান এর সঞ্চালনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভূমিকম্প সচেতনতা বিষয়ক একটি কি নোট পেপার উপস্থাপনা করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ। এ সময় আলোচনায় অংশ নেন ভূ তত্ত্ব ও ভূমিকম্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু সহনশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ইউএনডিপি’র প্রফেসর ড. মাহমুদুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ইএনসি মেজর জেনারেল (অব.) মেজর জেনারেল ইবনে ফজল শায়েকুজ্জামান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রি. জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান, ওয়ার্ল্ড ওয়াচ সোসাইটির পরিচালক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক কাজী ইমরুল কবীর সুমন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা মেইন্টেনেন্স পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার পিএসসি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স উপ-পরিচালক মামুন উর রশিদ, ঢাকা সিটি করপোরেশন এর চীফ আরবান অফিসার মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) এর প্রতিনিধি ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ বুলবুল, ভূতত্ববিদ তাহমিনা আক্তার, মানবাধিকার সংগঠক ফরিদ খান, লায়ন আক্তারুজ্জমান প্রমুখ।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক ও ওয়ার্ল্ড ওয়াচ সোসাইটির পরিচালক কাজী ইমরুল কবীর সুমন আলোচনায় অংশ নিয়ে জানান, ভূমিকম্পের বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কম। সেজন্য এর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা যদি সেই প্রস্তুতি এখন না নেই তাহলে ভূমিকম্পের কারণে নতুন করে মহাবিপর্যায় নেমে আসবে বাংলাদেশে। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে ৩০ বছর আগে মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরেরপুল, পল্টন এলাকায় ভূমিকম্প হওয়ার গুজবে একটি রাত সবাই বাড়ির বাইরে রাস্তায় কাটিয়েছিল। তখন সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে বড় রাস্তায়, প্রধান সড়কে অবস্থান করেছিল। সেসময় ভূমিকম্প না হলেও চরম আতঙ্কে ছিলাম সবাই। এ বছর নভেম্বরে যে ভূমিকম্প হল সেটা আমরা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বসে টের পেয়েছি ভালভাবেই। কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ভূ-কম্পণ হওয়ায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। এই আতঙ্ক থেকে মুক্ত থাকতে সঠিক কর্মপন্থা বেছে নিতে হবে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও এ নিয়ে দ্রুত গুজব রটে। আতঙ্কিত হয় সবাই। এ থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভূমিকম্পের বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কম। আমরা জানি না এরকম অবস্থায় আমরা কি করবো। ঢাকা সহ সারাদেশে বিল্ডিংকোড মেনে এখন আর বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে না। এসব বিষয়ে জরুরীভাবে সরকারকে তদারকি করা উচিত। পুরাতন ঢাকায় হয়তো পুরাতন ভবন রিপেয়ার করা সম্ভব। কিন্তু নতুন ঢাকায় যদি এভাবে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিল্ডিং তৈরি হয় তাহলে তো পুরো নগরী মৃত্যুফাঁদে পরিণত হবে। এ থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমিকম্প আতঙ্ক আমাদের কমাতে হবে। ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতির বিকল্প নেই’।
ভূতত্ত্ববিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশীরা আসলেই ভূমিকম্প বিষয় সচেতন নই। এর মেইন কারণ আমরা নিজেরাই জানিনা কি রকম মাটির উপর আমরা বসে আছি। আমাদের নিচের মাটির উপরের সেগমেন্টগুলো খুবই সফট, নরম। এগুলো ভূমিকম্প সহনশীল নয়। আমাদের উত্তরে হিমালয় এবং পূর্বে আরাকান ফোল্ডেড বেল্ট। আমাদের ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে ন্যাচারাল এবং প্রাকৃতিক। আমরা মানুষের তৈরি ন্যাচারাল সমস্যাগুলো সলভ করতে পারি। ভূমিকম্প প্রাকৃতিক কারণেই হবে। ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ। আমরা বাঙালিরা নিয়ম কানুন মানতে চাই না। সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার, নিয়ম মানার।’
দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু সহনশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ইউএনডিপি’র প্রফেসর ড. মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ একটা সময় দুর্যোগ হওয়ার পর সবাই কাজ করতো। আমরা এখন দুর্যোগ হওয়ার আগে ও পরের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসের নাম হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সিভিল ডিফেন্সের বিষয়ে আমাদের আরো বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রুত দুর্যোগের প্রস্তুতি নিতে হবে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রি. জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ‘পলিটিক্যাল যারা দায়িত্বে থাকবে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। স্মার্ট পলিটিক্যাল দলগুলোকে মানুষের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।’
ভূ তত্ত্ব ও ভূমিকম্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ডিজাস্টার সাইন্স’ কে আমাদের আরো গুরুত্ব দিতে হবে। সবাই আফটার ‘আর্থকোয়াক’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভূমিকম্পের প্রথম ২০ সেকেন্ড খুব ‘ক্রুশিয়াল’। সে সময় ভবন টিকে থাকবে, নাকি ভেঙ্গে যাবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
টার্কিতে ৫০ হাজার লোক মারা গেছে শুধু বিল্ডিং ধ্বসে। একটা মানুষকে উদ্ধারে কিন্তু হিউজ টাকার প্রয়োজন। রানা প্লাজার ঘটনার পর অনেক বিল্ডিং নতুন করে মজবুতিকরণ করা হয়েছে। ভূমিকম্প প্রবনতা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ভবনগুলো মজবুত আছে কিনা সেটা দেখতে হবে সবাইকে। মব ড্রিল করতে হবে। পুরনো ঢাকার মাটি ভালো, নতুন ঢাকার মাটি ভালো না। তবে, পুরনো ঢাকায় ভবনের শক্তি কমে যাওয়ার কারনে ভবনধ্বস হতে পারে। অন্যদিকে নতুন ঢাকায় মাটির কারণে ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ভূমিকম্পের পর গ্রীন, ইয়েলো, রেড এ তিন কালারে সকল ভবনকে চিহ্নিত করা উচিত। বর্তমানে ভূমিকম্প প্রকোপের পর সকল ভবনকে মার্কিং করা উচিত ছিল। ঢাকার ৭০ ভাগ ভবনে হালকা ক্র্যাক আছে। কোনো ভবনে ঝুঁকি আছে কিনা সেটা দেখতে হবে সবাইকে। রাজউক নতুন করে নোটিশ দিয়ে বিল্ডিং চেক করে সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। ভবন শক্ত হলে ভূমিকম্পের সময় মাথায় হাত রেখে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে কিছুটা রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
“ওয়ার্ল্ড ওয়াচ সোসাইটি”র চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফর রহমান বলেন, ‘ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কি করনীয় সে বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় রাখতে চাই আমরা। সেজন্য এরকম ভূমিকম্প সচেতনাতামূলক অনুষ্ঠান আমরা আগামীতে আরো আয়োজন করতে চাই। সবার সহযোগিতা পেলে আমরা এ ধরনের সামাজিক কাজ করতে আরো বেশী আগ্রহী হবো।’
এমআর/সবা
























