- ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা
- রেমিট্যান্সের ওপর প্রবাসীদের ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়
- গত তিন মাসেরও বেশি সময় পরিশোধ করা হচ্ছে না, বকেয়া বাড়ছে
ব্যাংকগুলো কার্যত কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো ছাড়াই সরকারের ভর্তুকির বোঝা বহন করছে। এভাবে যদি চলতেই থাকে, তাহলে ব্যাংকগুলো জটিলতার মধ্যে পড়বে- জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ
প্রবাসী আয়ের বিপরীতে সরকারের পক্ষ হয়ে ব্যাংকগুলো যে প্রণোদনা দেয়, তা তিন মাসের বেশি সময় ধরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া হয়ে পড়েছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাওয়া ও তারল্য সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো সরকারের পক্ষ হয়ে রেমিট্যান্সের ওপর প্রবাসীদের বর্তমানে ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়। এরপর সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সেই অর্থ ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করে। তবে গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে এই অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না; ফলে বকেয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রণোদনার বকেয়া ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বকেয়া আরো ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু ডিসেম্বরের প্রথম ১৭ দিনেই প্রবাসীরা ২ বিলিয়ন ডলারের ওপর রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে এখনো সেই অর্থ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোর ওপর প্রণোদনার চাপ আরও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকগুলো কার্যত কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো ছাড়াই সরকারের ভর্তুকির বোঝা বহন করছে। ‘এটা যদি সাময়িক হয়, তাহলে স্থায়ী কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু এভাবে যদি চলতেই থাকে, তাহলে ব্যাংকগুলো জটিলতার মধ্যে পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। কারণ এটা তো ব্যাংকের ঘাড়ের ওপর দিয়ে দিচ্ছে। এটা আর কতদিন চালাবে? এটা এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে কীভাবে হবে? কারণ রেমিট্যান্সের পরিমাণ তো বাড়ছে। চলতি মাসের ১৫ দিনে দেড় বিলিয়নের ওপর রেমিট্যান্স এসেছে। তাহলে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে তো ভর্তুকির চাপ তো বাড়ছে।’ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নলক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, এছাড়া সরকারের ঋণগ্রহণও বাড়ছে। এতে বোঝা যায়, সরকার আর্থিক চাপে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, মূল বাজেট কাঠামোর বাইরে গিয়ে সরকার একটি নবগঠিত একীভূত ইসলামি ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করেছে। ‘এ অর্থ সরকারের বাজেটেও ছিল না বলে মনে হয়। ব্যাংক সূত্র অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সিটি ব্যাংকের ১৮৫ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকের ৪৪৫ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪০০ কোটি ও পূবালী ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকার রেমিট্যান্সের প্রণোদনার বকেয়া রয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত এক মাসের মধ্যেই এ প্রণোদনার অর্থ সমন্বয় করা হতো। কিন্তু এখন তিন মাস পেরিয়ে গেলেও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না, যা আমানত-নির্ভর তহবিল ব্যবস্থাপনায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রণোদনার অর্থ বকেয়া থাকায় তহবিল ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়ছে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এ বিষয়ে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, সরকার থেকে এখনো অর্থ পাওয়া যায়নি,’ বলেন তিনি। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় করলেই ব্যাংকগুলোকে তা বন্টন করে দেওয়া হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, সময়মতো অর্থ না পাওয়ায় সরাসরি তাদের মুনাফায় ওপর প্রভাব পড়ছে। কারণ প্রণোদনার জন্য আটকে থাকা অর্থ অন্য কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বছর শেষে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো সাধারণত তাদের আমানত বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু প্রণোদনা পরিশোধে আমানতের অর্থ ব্যবহার করতে হওয়ায় বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা দিনশেষে ব্যাংকের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, প্রতি মাসে যদি কোনো ব্যাংকে ১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে ১২২.৩০ টাকা দরে, তাহলে সেটার বিপরীতে ১.২২ কোটি টাকার বেশি দিতে হয়। এর সঙ্গে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করলে সেটি টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১.২৫ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ ডলারে ৩ লাখ টাকার বেশি অর্থ সরাসরি ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল দিতে হচ্ছে, যা সরকারের পক্ষ থেকে পরিশোধ করার কথা। তিনি আরও বলেন, আগে ব্যাংকগুলো তিন মাসের অগ্রিম তহবিল পেত, যার ফলে তারা দ্রুত প্রণোদনার অর্থ সমন্বয় করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে এই অগ্রিম তহবিল প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে; কিছু ক্ষেত্রে বকেয়া পাওনা পেতে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় লাগছে। প্রণোদনা দিতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে থাকায় ব্যাংকগুলো ‘অপরচুনিটি কস্ট’-এর সম্মুখীন হচ্ছে। এ অর্থ এখন সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। বর্তমানে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মুনাফার হার প্রায় ১০.৭২ শতাংশ, যা ব্যাংকগুলোর আয়ের একটি প্রধান উৎস। কিন্তু তহবিল আটকে থাকায় ব্যাংকগুলো কম মুনাফার স্বল্পমেয়াদি খাতে অর্থ রাখতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের বার্ষিক মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে এক বছর পর ১০.৭২ কোটি টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু সরকার টাকা পরিশোধে দেরি করায় বিনিয়োগের কার্যকর সময় এবং মোট আয়—দুটোই কমে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান বলেন, তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রণোদনা বকেয়া থাকায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা সতর্ক করেছেন, শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলো এই চাপ সামলে নিতে পারলেও মাঝারি বা দুর্বল ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য সংকটে পড়ছে। পূবালী ব্যাংকের মোহাম্মদ আলী বলেন, যেসব ব্যাংকের তারল্য কম, তারা বেশি রেমিট্যান্স পেলেও সমস্যায় পড়বে। এছাড়া ডলার বাজার স্থিতিশীল ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো হওয়ায় এখনো প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, বিষয়টি সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয় নয়। তিনি বলেন, ‘সরকার যেহেতু ভর্তুকি দিচ্ছে, সুতরাং অর্থ আসবে। তা বিলম্ব হতে পারে, তবে মিস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রণোদনার অর্থ কখনোই মাসিক ভিত্তিতে ছাড় করা হয় না। এটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগে যখন রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়ে যায়, তখন ব্যাংকগুলোর অনুরোধে অনেক সময় অগ্রিম অর্থও দেওয়া হয়। তাই অর্থ ছাড়ে দুই-তিন মাসের বিলম্ব উদ্বেগের কিছু নয়; এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’
























