০২:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কৃষিঋণ বঞ্চিত সাধারণ কৃষক

➤ব্যাংক সিস্টেমের জটিলতায় এই সেবায় আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে
➤ঋণ নেওয়া কৃষকদের বিরুদ্ধে ঝুলছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯ মামলা
➤ঋণের সুযোগ নিচ্ছে প্রভাবশালী ও স্থানীয় মহাজনরা
➤চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা
➤দেশের ৪০% কৃষক এখনো কৃষিঋণের আওতা বহির্ভূত

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১১.৩৮ শতাংশ। অথচ বাস্তবে এটি অনেকটা অবহেলিত একটি খাত। বছরের পর বছর কৃষিকাজ করে লোকসান করছেন কৃষকরা। কষ্টের ফসলের দাম না পেয়ে তা খেতে পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে অনেক সময়। ফসল উৎপাদনে যা খরচ হয়, তা আবার উঠে আসে না। দেশের মোট শ্রমজীবীর ৪৫.৩৩% প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর ঋণ প্রদানের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও প্রান্তকি পর্যায়ে থেকে যায় বিভিন্ন সমস্যা। কৃষি ঋণের সহজপ্রাপ্যতা না হওয়ায় প্রকৃত কৃষকরা এই সেবার আওতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা এই সেবার আওতায় আসছেন তাদের ঋণ পরিশোধে বিলম্ব হলে কপালে জুটছে সার্টিফিকেট মামলা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৪০% কৃষক এখনো কৃষিঋণের আওতার বহির্ভূত।

কৃষিঋণ নিয়ে গত বছরের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেওয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, কৃষিঋণ বিতরণে শস্য ও ফসল, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ- এই তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যাংকের বরাদ্দকৃত লক্ষ্যমাত্রার ৬০% শস্য ও ফসল খাতে, ১৩% মৎস্য খাতে এবং ১৫% প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত, যেমন : হর্টিকালচার (মৌসুমি ফুল ও ফল চাষ), মাছ চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তার শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন।

কৃষক ঋণ পাবেন কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী। এ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাদের জমি নেই, তারাও এই ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষককে যার জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন, সেই ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে প্রান্তিক খেটে খাওয়া ভূমিহীন চাষি কখনোই চুক্তি করে জমি লিজ নেন না। আর অকৃষক জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না। এ জন্য বর্গাচাষির দোষ নেই, কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে সরকারকে ফি দিতে হয়। সেই ফি জমির মালিককেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে, এই পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ থেকে বর্গাচাষির ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ ধান চাষ করেন, কোনো একটা এলাকায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বড় অংশ ব্যাংক পর্যন্ত যান ঋণের জন্য, তাহলে ওই অঞ্চলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশই কেবল ধানচাষিরা পাবেন।

 

কৃষকের বহুমুখী ঋণের জাল লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২২ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমজীবীর ৪৫.৩৩% প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। এর বড় অংশের হাতে আবার নিজের জমি নেই। জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অকৃষক। তাদের মধ্যে যারা বেশি অবস্থাসম্পন্ন, তারা রাজধানীতে, তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী বড় জেলা শহর ও উপজেলায় থাকেন। বড় ধরনের জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের জন্য কিছু করা সম্ভব না। কারণ, দেশে ঋণ পাওয়া একটা জটিল বিষয় হওয়ায় কৃষকেরা অধিকাংশ সময় এনজিও এবং মহাজনী ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

সাধারণত ঋণ পরিশোধে একটু দেরি হলেই কপালে জুটছে সার্টিফিকেট মামলা এবং হয়রানি। সারা দেশে সার্টিফিকেট মামলা এখন ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি। এর মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জনের নামে। অডিট আপত্তি থেকে বাঁচতে অনেক সাধারণ মানুষের নামে সার্টিফিকেট মামলা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ১৫ বছরের বেশি সময় ঝুলে থাকা সব সার্টিফিকেট মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভার সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ওই নির্দেশনা দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই সভার কার্যপত্রে বলা হয়, সারা দেশে কৃষক-জেলেদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১ হাজার ৯৬২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ব্যাংকটির মামলা ৫৬ হাজার ৮০০। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ২১৯ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলা ১৭ হাজার ৫৯৮। অনাদায়ী টাকা প্রায় ১০৩ কোটি। সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৩৯ কোটি টাকা; এর বিপরীতে মামলা ১০ হাজার ২৮৪টি। রূপালী ব্যাংক মামলা করেছে ২ হাজার ৫৫০টি। তাদের দাবি করা টাকা ৫ কোটি।

কৃষিঋণের বিষয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ঋণ নিতে গেলে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই যার কারণে ব্যাংকে তারা দলিল জমা দিতে পারে না। তাদের অধিকাংশ জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। তাছাড়া ব্যাংকে গেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় কাগজ জমা প্রদান করার পরও সময় অনুযায়ী টাকা পায় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। এটি মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম ৭ মাস) এ ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৬০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সে হিসাবে গত বারের তুলনায় ২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ বাড়লেও শতাংশের হারে কিছুটা কমেছে।
কৃষিঋণের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান সবুজ বাংলাকে বলেন, গত দশ বছরে কৃষি ঋণের পরিমাণ ৮-৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত কৃষক ঋণ পাচ্ছে না। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয়রানি রয়েছে। এই হয়রানির কারণে কৃষক ঋণ নিতে ব্যাংকে যায় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষকের দোরগোড়ায় গিয়ে কৃষককে উৎসাহিত করবে আর ঋণ দিবে- এই পদ্ধতি নেই। অনেক সময় অনেক এনজিও কৃষকদের কাছে ঋণ নিয়ে যায়। তারা অনেক সময় কৃষিঋণের কথা বলে অন্যন্যা খাতে ঋণ বিতরণ করে। দিন দিন কৃষিঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কৃষকরা কতটুকু সুফল ভোগ করছে তার জন্য মাঠ পর্যায়ে আরো তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যদি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায় তাহলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। ঋণের পরিমাণ বাড়লেও এখনো পর্যন্ত দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ৪০% কৃষক এই কৃষিঋণের আওতা থেকে বঞ্চিত।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকৃত বর্গাচাষিরা যাতে এই প্রান্তিক সুযোগ পায় সেজন্য নিয়ম আরো সহজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় যে ঋণের সীমা নির্ধারণ করা আছে এই ঋণ যাতে সঠিকভাবে বিতরণ করে।

কৃষিঋণ এবং সার্টিফিকেট মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সবুজ বাংলাকে বলেন, বর্গাচাষিদের জন্য আলাদা ঋণ স্কিম করা দরকার। তাদের জন্য আলাদা শর্ত দেওয়া দরকার। একটি বিষয় হচ্ছে বর্গাচাষিরা যদি বিনিয়োগ না করে তাহলে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। ঋণ দেওয়ার জন্য তাদের মালিকানা না থাকলে বিকল্প উপায়ে তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

সার্টিফিকেট মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলার ক্ষেত্রে কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি হওয়া দরকার। ব্যাংকগুলো যখন ঋণ প্রদান করে তখন তাদের যাচাই করা দরকার কারা প্রকৃত কৃষক ও কারা কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য ঋণ নিচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের ঋণ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজ দিয়ে ঋণ নিয়ে তারা পরিশোধ করে না। যারা কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে লস হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সহানুভূতি হওয়া দরকার। আর যারা ঋণ নিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করে নাই তাদের যাচাই করা।

জনপ্রিয় সংবাদ

কৃষিঋণ বঞ্চিত সাধারণ কৃষক

আপডেট সময় : ০৭:২৫:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

➤ব্যাংক সিস্টেমের জটিলতায় এই সেবায় আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে
➤ঋণ নেওয়া কৃষকদের বিরুদ্ধে ঝুলছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯ মামলা
➤ঋণের সুযোগ নিচ্ছে প্রভাবশালী ও স্থানীয় মহাজনরা
➤চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা
➤দেশের ৪০% কৃষক এখনো কৃষিঋণের আওতা বহির্ভূত

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১১.৩৮ শতাংশ। অথচ বাস্তবে এটি অনেকটা অবহেলিত একটি খাত। বছরের পর বছর কৃষিকাজ করে লোকসান করছেন কৃষকরা। কষ্টের ফসলের দাম না পেয়ে তা খেতে পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে অনেক সময়। ফসল উৎপাদনে যা খরচ হয়, তা আবার উঠে আসে না। দেশের মোট শ্রমজীবীর ৪৫.৩৩% প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর ঋণ প্রদানের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও প্রান্তকি পর্যায়ে থেকে যায় বিভিন্ন সমস্যা। কৃষি ঋণের সহজপ্রাপ্যতা না হওয়ায় প্রকৃত কৃষকরা এই সেবার আওতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা এই সেবার আওতায় আসছেন তাদের ঋণ পরিশোধে বিলম্ব হলে কপালে জুটছে সার্টিফিকেট মামলা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৪০% কৃষক এখনো কৃষিঋণের আওতার বহির্ভূত।

কৃষিঋণ নিয়ে গত বছরের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেওয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, কৃষিঋণ বিতরণে শস্য ও ফসল, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ- এই তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যাংকের বরাদ্দকৃত লক্ষ্যমাত্রার ৬০% শস্য ও ফসল খাতে, ১৩% মৎস্য খাতে এবং ১৫% প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত, যেমন : হর্টিকালচার (মৌসুমি ফুল ও ফল চাষ), মাছ চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তার শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন।

কৃষক ঋণ পাবেন কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী। এ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাদের জমি নেই, তারাও এই ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষককে যার জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন, সেই ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে প্রান্তিক খেটে খাওয়া ভূমিহীন চাষি কখনোই চুক্তি করে জমি লিজ নেন না। আর অকৃষক জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না। এ জন্য বর্গাচাষির দোষ নেই, কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে সরকারকে ফি দিতে হয়। সেই ফি জমির মালিককেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে, এই পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ থেকে বর্গাচাষির ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ ধান চাষ করেন, কোনো একটা এলাকায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বড় অংশ ব্যাংক পর্যন্ত যান ঋণের জন্য, তাহলে ওই অঞ্চলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশই কেবল ধানচাষিরা পাবেন।

 

কৃষকের বহুমুখী ঋণের জাল লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২২ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমজীবীর ৪৫.৩৩% প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। এর বড় অংশের হাতে আবার নিজের জমি নেই। জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অকৃষক। তাদের মধ্যে যারা বেশি অবস্থাসম্পন্ন, তারা রাজধানীতে, তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী বড় জেলা শহর ও উপজেলায় থাকেন। বড় ধরনের জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের জন্য কিছু করা সম্ভব না। কারণ, দেশে ঋণ পাওয়া একটা জটিল বিষয় হওয়ায় কৃষকেরা অধিকাংশ সময় এনজিও এবং মহাজনী ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

সাধারণত ঋণ পরিশোধে একটু দেরি হলেই কপালে জুটছে সার্টিফিকেট মামলা এবং হয়রানি। সারা দেশে সার্টিফিকেট মামলা এখন ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি। এর মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জনের নামে। অডিট আপত্তি থেকে বাঁচতে অনেক সাধারণ মানুষের নামে সার্টিফিকেট মামলা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ১৫ বছরের বেশি সময় ঝুলে থাকা সব সার্টিফিকেট মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভার সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ওই নির্দেশনা দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই সভার কার্যপত্রে বলা হয়, সারা দেশে কৃষক-জেলেদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১ হাজার ৯৬২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ব্যাংকটির মামলা ৫৬ হাজার ৮০০। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ২১৯ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলা ১৭ হাজার ৫৯৮। অনাদায়ী টাকা প্রায় ১০৩ কোটি। সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৩৯ কোটি টাকা; এর বিপরীতে মামলা ১০ হাজার ২৮৪টি। রূপালী ব্যাংক মামলা করেছে ২ হাজার ৫৫০টি। তাদের দাবি করা টাকা ৫ কোটি।

কৃষিঋণের বিষয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ঋণ নিতে গেলে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই যার কারণে ব্যাংকে তারা দলিল জমা দিতে পারে না। তাদের অধিকাংশ জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। তাছাড়া ব্যাংকে গেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় কাগজ জমা প্রদান করার পরও সময় অনুযায়ী টাকা পায় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। এটি মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম ৭ মাস) এ ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৬০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সে হিসাবে গত বারের তুলনায় ২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ বাড়লেও শতাংশের হারে কিছুটা কমেছে।
কৃষিঋণের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান সবুজ বাংলাকে বলেন, গত দশ বছরে কৃষি ঋণের পরিমাণ ৮-৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত কৃষক ঋণ পাচ্ছে না। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয়রানি রয়েছে। এই হয়রানির কারণে কৃষক ঋণ নিতে ব্যাংকে যায় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষকের দোরগোড়ায় গিয়ে কৃষককে উৎসাহিত করবে আর ঋণ দিবে- এই পদ্ধতি নেই। অনেক সময় অনেক এনজিও কৃষকদের কাছে ঋণ নিয়ে যায়। তারা অনেক সময় কৃষিঋণের কথা বলে অন্যন্যা খাতে ঋণ বিতরণ করে। দিন দিন কৃষিঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কৃষকরা কতটুকু সুফল ভোগ করছে তার জন্য মাঠ পর্যায়ে আরো তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যদি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায় তাহলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। ঋণের পরিমাণ বাড়লেও এখনো পর্যন্ত দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ৪০% কৃষক এই কৃষিঋণের আওতা থেকে বঞ্চিত।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকৃত বর্গাচাষিরা যাতে এই প্রান্তিক সুযোগ পায় সেজন্য নিয়ম আরো সহজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় যে ঋণের সীমা নির্ধারণ করা আছে এই ঋণ যাতে সঠিকভাবে বিতরণ করে।

কৃষিঋণ এবং সার্টিফিকেট মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সবুজ বাংলাকে বলেন, বর্গাচাষিদের জন্য আলাদা ঋণ স্কিম করা দরকার। তাদের জন্য আলাদা শর্ত দেওয়া দরকার। একটি বিষয় হচ্ছে বর্গাচাষিরা যদি বিনিয়োগ না করে তাহলে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। ঋণ দেওয়ার জন্য তাদের মালিকানা না থাকলে বিকল্প উপায়ে তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

সার্টিফিকেট মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলার ক্ষেত্রে কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি হওয়া দরকার। ব্যাংকগুলো যখন ঋণ প্রদান করে তখন তাদের যাচাই করা দরকার কারা প্রকৃত কৃষক ও কারা কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য ঋণ নিচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের ঋণ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজ দিয়ে ঋণ নিয়ে তারা পরিশোধ করে না। যারা কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে লস হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সহানুভূতি হওয়া দরকার। আর যারা ঋণ নিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করে নাই তাদের যাচাই করা।