রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই ক্রমেই বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিশেষ করে লেখাপড়ার জন্য বাড়তি চাপাচাপি ফলাফল খারাপ হলে সমাজ ও পরিবারের গালমন্দ এবং বিরূপ মন্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তাদের ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে। এবারের এসএসসি ফলাফল প্রকাশের পর গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তাদের এমন মৃত্যু অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবনার সময় এসেছে এখন। বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৪ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মহত্যা করেছে ১৮৮ জন শিক্ষার্থী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক চাপ, দারিদ্র্য, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উসকে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বাড়ন্ত এ শিক্ষার্থীর বিষয়ে পরিবার বুঝে ওঠার আগেই আত্মাহুতিতে অবসান ঘটছে একেকটি ছোট জীবনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পেছনে প্রেমঘটিত ঘটনা, লেখাপড়ার জন্য পরিবারের বাড়তি চাপ, পরীক্ষায় ফলাফল সন্তোষজনক না হলে মা-বাবার বকাঝকা ও সমাজের বিরূপ মন্তব্য দ্রুত কাজ করছে শিক্ষার্থীদের মনে। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলতে সঙ্গ দেওয়াসহ সমাজ ও পরিবারকে আরও যত্নশীল হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছরই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কোনো না কোনো কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। এবছরও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১২ মে। ফল প্রকাশের পর সারাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। নোয়াখালী, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মাগুরা জেলায় এসব ঘটনা ঘটেছে। একই ঘটনায় আরও অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের চেষ্টা চালিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হবিগঞ্জে পরীক্ষায় ফেল করার কারণে বিষপানে মারা যায় শুভ আহমেদ নামের এক ছাত্র। সে সদর উপজেলার পৈল পশ্চিম পাড়া গ্রামের লিলু মিয়ার ছেলে।
নিহতের পরিবার জানায়, গত ১২ মে এসএসসির রেজাল্ট প্রকাশের পর সে ফেল করে। পরবর্তীতে দুপুর ২টার দিকে বাসায় ফিরে সবার অগোচরে বিষপান করে শুভ ছটফট করতে থাকে। বিষয়টি টের পেয়ে পরিবারের লোকজন তাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত একটার দিকে তার মৃত্যু ঘটে। এর আগে মাইশা আক্তার (১৭) নামে আরও এক কিশোরী বিষপানে আত্মহত্যা করে। মৃত মাইশা আক্তার কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার আদমপুর গ্রামের মজিদ মিয়ার কন্যা। সে স্থানীয় দেওয়ান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। অপরদিকে, বাহুবল উপজেলার মহব্বতপুর গ্রামের কিশোর মেহেদী হাসান স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়।
সে একটি বিষয়ে ফেল করায় পরিবারের বকা খেয়ে ক্ষোভে-অভিমানে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এসব আত্মহত্যার ঘটনাগুলো দৈনিক সবুজ বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অজয় চন্দ্র দেব। এদিকে কাক্সিক্ষত ফল না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সুমাইয়া আক্তার। তার হতদরিদ্র বাবা বলেন, আমি খেটেখাওয়া মূর্খ মানুষ। আমার কাগজ-পাতি ধরার মতো কেউ নাই। তাই আমার মেয়েটাকে নিয়ে একটু আশা করছিলাম তাকে শিক্ষিত বানানোর। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। উল্টো মেয়েটি অভিমান করে চিরদিনের জন্য পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে পাড়ি দিল না ফেরার দেশে। এখন আমি আর কাকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধবো।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে দেশে আত্মহনন করেছে ৫১৩ শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে এসে কিছুটা কমলেও এবার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ মে পর্যন্ত সারা দেশে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ১৮৮ জন শিক্ষার্থী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক সময় প্রেমঘটিত কোনো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ও পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। একটি সমাজ বা পরিবারে আত্মহত্যার কোনো ঘটনা ঘটলে, সমাজ বা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও মধ্যেও আত্মহননের ঝুঁকি থেকে যায়। তবে সমাজ ও পরিবার সহযোগিতার হাত বাড়ালেই বদলাতে পারে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত এমন ঘটনা।
মনোবিজ্ঞানী রাউফুন নাহার বলেন, পরীক্ষায় খারাপ করলে মা-বাবারা সরাসরি বলে আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। তখন শিশু বা শিক্ষার্থীরা কিন্তু মনে করে তাদের বেঁচে থাকার কোন মানেই নাই। তবে বাইরে থেকে যতই চাপ আসুক, পরিবার ঠিক থাকলে কিন্তু এগুলো কোনো বিষয়ই না।
শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঙ্গীতা ইমাম বলেন, যারা পরীক্ষা ভালো করে, তাদের নিয়ে সবাই উৎসব করে। রাষ্ট্রও তাদের নিয়ে উৎসব করে। কিন্তু যারা ঝরে গেল, তাদের তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কেন এরা এবার পারল না, কেন পারল না। সেগুলো নিয়ে তাদের সহযোগিতা করা জরুরি দরকার। এটা কিন্তু আমাদের মধ্যে নেই।
লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, যখন ঘটনা ঘটছে, তখন আমরা কথা বলছি। কিন্তু কয়েকদিন পরই থেমে যাচ্ছি। কিন্তু এটাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের একটা সামাজিক সংকট আছে। তবে কি দারিদ্র, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি আর সোশ্যাল মিডিয়া সবটাই উসকে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের? নাকি সমাজ বিষণ্নতা, মানসিক চাপ কিংবা আত্মহনন প্রবণতার স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত কারণগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতার বিকল্প নেই।
পদ্ধতিগত দিকগুলোকে মাথায় রেখেই শিক্ষার্থীদের সার্বিক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বন্ধুসুলভ আচরণ ও সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি আরও যত্নশীল হতে হবে। তবেই এমন অঘটন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে শিক্ষার্থীরা। পরিবার ফিরে পেতে পারে মেধাবী সন্তানকে।













