➣অবাধে ব্যবহার হচ্ছে রাস্তার মোড়ে ও ট্রাফিক সিগন্যালে
➣ব্যবহারের কারণ ও পাশ্বপ্রতিক্রিয়া জানে না পুলিশ
➣আলোর ঝলকানিতে দুর্ঘটনা ও চালকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার শঙ্কা
প্রতিদিনই সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে রাত বাড়লেই ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে দেখা মেলে সবুজ রঙের লেজার লাইটের রশ্মি। রাতে যান নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে আর ট্রাফিক সিগন্যালে লেজার লাইট অবাধে ব্যবহার করছেন ট্রাফিক ও ফাঁড়ির টহল পুলিশের সদস্যরা। এমনকি এ লাইট কমিউনিটি পুলিশের সদস্যরাও এ লাইট ব্যবহার করতে ভুল করেন না। তবে এমন লাইট কেন ব্যবহার করছেন এবং পাশর্^প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জানেন না ভয়ঙ্কর এ লেজার লাইট ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, সড়কে যানজট নিরসনে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতেই এ লাইট ব্যবহার করছেন। এদিকে পরিবহন চালকদের অভিযোগ, এই আলো চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক ঝাপসা হয়ে আসে সব, পরবর্তীতে চোখে জ্বালা পোড়াসহ নানান সমস্যায়ও ভুগতে হয় তাদের। মাঝেমধ্যে পথচারী কিংবা অন্য যানবাহনের সঙ্গে দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর এই লেজার লাইটের ব্যবহার শুধু চালককেই ক্ষতি করে না, দুর্ঘটনার বড় কারণও হতে পারে। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেজার লাইটের আলোক রশ্মি মানুষের চোখের মনিতে পড়লে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার শঙ্কা থেকেই যায়। মাঝেমধ্যে চোখের ছানি পড়ার বড় সহায়কও হয়ে ওঠে। এগুলোর অবাধ ব্যবহার রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞদের।
রাজধানীর ব্যস্ততম বিভিন্ন সড়কে ঘুরে দেখা যায়, সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে এমনিক ট্রাফিক সিগন্যাল ঘিরে ভয়ঙ্কর এ লেজার লাইটের অবাধ ব্যবহার করছেন ট্রাফিক ও ফাঁড়ি পুলিশের টহল টিম। সন্ধ্যার পর থেকেই গভীর রাত পর্যন্ত এর ব্যবহার বাড়ে শতভাগ। রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী, টেকনিক্যাল মোড়, মিরপুর-পল্লবী, কাফরুল, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, পান্থপথ ক্রসিং, রাসেল স্কয়ার, বাংলা মোটর, সায়েন্সল্যাব মোড়, নীলক্ষেত মোড়, আজিমপুর চৌরাস্তা, পলাশী মোড়, বকশীবাজার চৌরাস্তা, নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ, চানখাঁরপুল চৌরাস্তা, বঙ্গবাজার মোড়, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে, নয়াবাজার-তাঁতীবাজার মোড়, রায়সাহেব বাজার চৌরাস্তা, ফুলবাড়িয়া ব্রিজের নিচে, গুলিস্তানের গোলাপশাহ, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, রাজউক মোড়, কাকরাইল মোড়, মালিবাগ চৌরাস্তা, রামপুরা, বাড্ডা, বনানী, মহাখালী, সাতরাস্তা মোড়, মৎস্য ভবন মোড়সহ নগরীর বিভিন্ন সড়কে এ চিত্র দেখা যায়।
কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন যানবাহনের নিয়ন্ত্রণে ভয়ঙ্কর এ লেজার লাইট টার্গেটকৃত গাড়ির দিকে ছুড়ছেন। গাড়ির গ্লাসে আলোক রশ্মি পড়ার মুহূর্তে তা ছড়িয়ে চালকের চোখে ও সামনের আসনে থাকা যাত্রীদের চোখে পড়ছে। এতে তাৎক্ষণিক চোখে ঝাপসা দেখেন চালক ও যাত্রীরা। গুলিস্তানে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট নুরুজ্জামান, পুলিশ সদস্য আমজাদ লেজার লাইট নিয়ে যানজট নিরসনে টার্গেটকৃত থামানো গাড়ি লক্ষ্য করে আলো ছুড়েন। রাত ১১টার দিকে একই চিত্র দেখা গেছে নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধে। নবাবগঞ্জ সেকশন ফাঁড়ির টহল টিমের সদস্যরা বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে রাস্তায় চলাচলকারী পণ্যবাহী গাড়ি লক্ষ্য করে সাইড করার নির্দেশনাস্বরূপ লেজার লাইটের আলো গাড়ির সামনের গ্লাসে নিক্ষেপ করছেন। এরপর চালক তা বুঝতে পেরে গাড়ি সাইড করছেন। তখন পুলিশ সদস্যরা কাগজপত্র তল্লাশির নামে বখরা আদায় করে ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন ভয়ঙ্কর চিত্র রাতের বেলায় বেশি দেখা যায়। পুলিশ সদস্যরা অবাধে এসব লাইট ব্যবহার করছেন। ভয়ঙ্কর এ লেজার লাইটের ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে ট্রাফিক সদস্য হেলাল প্রথমে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য আনিস, আব্দুর রহমান ও কাজিমুল দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, এটা ব্যবহারে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে রাতের বেলায় হাতের ইশারা দেখেও না দেখার ভান করে বিভিন্ন যানবাহন যত্রতত্র পার্কিং ও গণপরিবহনগুলো এলোমেলো করে সড়কের ওপর থামিয়ে যাত্রী তোলা রোধ এবং গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতেই এ ধরনের লাইট ব্যবহার করছেন তারা। তবে এর পাশর্^প্রতিক্রিয়া বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই বলে জানান।
পরিবহন চালকরা জানান, সন্ধ্যার পর থেকেই লেজার লাইটের ব্যবহার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চলন্ত একটি গাড়িতে হঠাৎ এই আলো চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক ঝাপসা হয়ে আসে সব, পরবর্তীতে চোখে জ্বালা পোড়াসহ নানান সমস্যায়ও ভুগতে হয় তাদের। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কাও বেড়ে যায়। মাঝেমধ্যেই লেজার লাইটের আলোক রশ্মিতে চোখে কিছু না দেখে মামলার ভয়ে সামনে এগোতে গিয়ে দেখা যায় কোনো যাত্রী নামতে গিয়ে বা রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় আহন হচ্ছেন। কখনো কখনো গাড়িও অদৃশ্য ছায়ার ওপর ভর করে সামনে এগোতে গিয়ে পুটপাত বা আইল্যান্ডের সঙ্গে এমনকি অপর গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনায় পড়ছে। লেজার লাইট ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছেন চালকসহ সাধারণ যাত্রী ও পথচারীরা। মোটরসাইকেল চালক সোহেল রানা বলেন, রাতের বেলা হঠাৎ করেই পুলিশ যখন লেজার লাইট মারে, তখন কিছু বুঝে উঠার আগেই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। অনেক সময় গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কোনো না কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। লাইটের আলোক রশ্মিতে বাইকারদেরও নানান ধরণের সমস্যার মুখে পড়তে হয় বলে জানান সোহেল রানাসহ আরো অনেক বাইকার।
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, ক্ষতিকর এই লাইট ব্যবহারে কেবল চালকের ক্ষতিই নয়, দুর্ঘটনার বড় কারণও হয়ে উঠতে পারে। তিনি আরও বলেন, পুলিশ সদস্যরা হয়তো টার্গেট করে লেজার লাইট ব্যবহার করেন না, তবে এর আলোর ঝলকানিতে ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, যারা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তারাই যদি এর অপব্যবহার করে তবে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি একটি দায়বদ্ধতাও চলে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মইনুল খোকন বলেন, লেজার লাইট ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়, লেজার লাইটের আলোক রশ্মি চোখের মনিতে পড়লে চোখের মধ্যে পাশর্^প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে নানান রোগ বাসা বাঁধতে পারে। এর ফলে হতে পারে ক্যান্সারও। তবে ট্রাফিক পুলিশের এই লেজার লাইট ব্যবহারে হয়তো ক্যান্সার হবে না কিন্তু চোখে ছানি পড়তে পারে। চালকের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আর সড়ক দুর্ঘটনা ঝুঁকি কমাতে লেজার লাইট ব্যবহার না করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।













