আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হুঁশিয়ারির পরও থামেনি সব ধরনের আন্তঃজেলা ও লোকাল রুটে চলাচলকারী যাত্রী পরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্য। ঈদের ছুটিতে গত ১৫ জুন থেকে সারা দেশে অব্যাহত রয়েছে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের কার্যক্রম। এ নিয়ে প্রায়ই চালক-হেলপারদের সঙ্গে যাত্রীদের চলছে তর্ক-বিতর্ক এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ীর টানে ঘরে ফেরার পথে পরিবার নিয়ে ভাড়া বিড়ম্বনায় পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। ঈদ শেষে এবার ঢাকায় কর্মস্থলে ফেরার পালা। এ সুযোগে দেশের সব রুটের যাত্রীদের কাছ থেকে বাস মালিকেরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ সময়ের তুলনায় কথিত বখশিস ও ফিরতি ট্রিপে যাত্রী না থাকার অজুহাতে দেড় থেকে দুই-তিনগুণ ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। এতে যাত্রীরা যাওয়া ও আসার পথে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ায় যাত্রীরা বিপাকে পড়ছেন। কোথাও অভিযোগ করেও কেউ এর প্রতিকার পাচ্ছেন না। ফলে নিরুপায় হয়ে যাত্রীদের বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। গত দু’দিন বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড ঘুরে যাত্রী সাধারণসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার, ফুলবাড়িয়া মার্কেট সংলগ্ন ফ্লাইওভারের নিচে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-বালিগাঁও, ঢাকা-শরীয়তপুর, ঢাকা-পিরোজপুর রুটে চলছে ইলিশ পরিবহন, গাংচিল, এমাদ, দোলাসহ অন্যান্য যাত্রী পরিবহন। প্রতিটি পরিবহন রাস্তার একপাশ দখলে রেখে যাত্রী ওঠা-নামা করছে। ঈদের দু’দিন পর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় নিজ গ্রামে বেড়াতে যান রেদোয়ান নামের এক যাত্রী। তিনি জানান, ঢাকা-বালিগাঁও রুটে চলাচলকারী গাংচিল ও ইলিশ পরিবহনে ইতোপূর্বে ভাড়া বাড়িয়ে গাংচিল পরিবহনে ১০০ টাকা ও ইলিশ পরিবহনে ১২০ নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু বাসে ওঠার আগেই হেলপার-কন্ডাক্টর ও চালক উচ্চস্বরে হাঁকডাক দিয়ে যাত্রী তোলার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, বাসে উঠে যেখানেই নামেন জনপ্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা। ওই যাত্রী বলেন, ঢাকা থেকে লৌহজংয়ের বালিগাঁওয়ের দূরত্ব মাত্র ৩৮ কিলোমিটার। কিন্তু ভাড়া নেওয়া হচ্ছে দেড় থেকে দ্বিগুণ। আশপাশে ট্রাফিক পুলিশ ও টহল পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও কেউ যাত্রীদের এমন অসহায়ের কথা শুনছেন না। এতে পরিবহন মালিকরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকেই তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে দেড় থেকে দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে যাত্রীদের পকেট কেটে নিচ্ছে। একই অভিযোগ করেন আমেনা খাতুন, মোতালেব মিয়া ও আজাহার হাওলাদার।
লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন-গুলিস্তান রুটে চলাচল করে প্রায় দেড়শ’ লেগুনা। এই রুটের ভাড়া ২০ টাকা নির্ধারিত হলেও ঈদের দু’দিন আগে ৫ টাকা বাড়িয়ে ২৫ টাকা করে আদায় করে নিয়েছে চালকসহ পরিবহন মালিকরা। প্রতিবাদ জানালেই তিরষ্কার নিয়ে নেমে যেতে হয় যাত্রীদের। যা গতকাল পর্যন্ত এমন ভাড়া নৈরাজ্য চলতে দেখা যায়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি মোবাইলের দোকানে কাজ করেন শরীয়তপুর সদর উপজেলার ধানুকা গ্রামের আবু রাহাত খান। তিনি গতকাল শরীয়তপুর সুপার সার্ভিসের একটি বাসে করে শরীয়তপুর সদর থেকে থেকে ঢাকায় আসেন। তার কাছ থেকে মাঝপথে ৫০০ টাকা বাসভাড়া নেওয়া হয়েছে। আবু রাহাত খান বলেন, আমরা গরিব মানুষ। স্বল্প বেতনে কাজ করি। সারা বছরের সঞ্চয় দিয়ে ঈদ উদযাপন করি। সেই কষ্টের টাকা যদি বাসের মালিক-শ্রমিকেরা রেখে দেন, তাহলে আমরা কোথায় যাব? একইদিন সকালে সদর উপজেলার চর চিকন্দি এলাকার কামরুল খান পরিবারের দুই সদস্যকে নিয়ে ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যান। তাদের কাছ থেকে ৬০০ টাকা করে বাসভাড়া আদায় করা হয়েছে। যাত্রীরা দাবি করেছেন, সরকার এবং পরিবহন কর্তৃপক্ষ যেন এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ঈদে যাত্রীদের নির্বিঘ্নে এবং স্বাভাবিক ভাড়ায় যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। জেলার বিভিন্ন স্থানে যাত্রীরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, প্রতিবার ঈদের সময়ই বাস মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেন এবং যাত্রীরা উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিচ্ছেন। এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে অনেকে অনৈতিক এবং অমানবিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই ভাড়া বৃদ্ধি যৌক্তিক সীমার বাইরে চলে গেছে এবং এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে বলেও জানান ভুক্তভোগী যাত্রীরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) শরীয়তপুর কার্যালয় ও শরীয়তপুর আন্তঃজেলা বাস ও মিনি বাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের মানুষ পদ্মাসেতু পারাপার হয়ে বাসে ঢাকায় যাতায়াত করেন। শরীয়তপুর পৌর বাস টার্মিনাল ও নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জের কদমতলা পর্যন্ত বাস চলাচল করে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই পথে প্রতিদিন তিন শতাধিক বাস চলে। গড়ে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর একেকটি বাস গন্তব্যে ছেড়ে যায়। প্রতিদিন ৮-১০ হাজার মানুষ বাসে চড়ে এ পথে যাতায়াত করেন। ঈদের ছুটিতে যাত্রীসংখ্যা আরও বেড়ে যায়। শরীয়তপুর শহর থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব ৭৩ কিলোমিটার। বিআরটিএ এ পথে বাসের যাত্রী ভাড়া ২৯৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। শরীয়তপুর বাস মালিক সমিতি ২৫০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী আনা-নেওয়া করে। তবে কোরবানির ঈদ ঘিরে গত শনিবার (১৫ জুন) থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ জুন) পর্যন্ত যাত্রীদের কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
ভাড়া বেশি নেওয়া প্রসঙ্গে শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস বাসের চালক সানি বলেন, ঢাকা থেকে শরীয়তপুরে খালি বাস নিয়ে যেতে হচ্ছে। যাওয়ার সময় যাত্রী হলেও আসার সময় কোনো যাত্রী থাকে না। তাই যাওয়া-আসার খরচ সমন্বয় করতে ভাড়া একটু বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে শরীয়তপুরে আন্তঃজেলা বাস ও মিনি বাস মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহম্মেদ তালুকদার বলেন, ঈদের সময় যাত্রীদের চাপ বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত সার্ভিস চালাতে হয়। শরীয়তপুর থেকে যাওয়ার সময়ই অতিরিক্ত যাত্রী আছে। কিন্তু ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যাওয়ার সময় কোনো যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীরা যাতে শরীয়তপুরের বিভিন্ন বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে না থাকেন, সেই কথা বিবেচনা করে ঢাকা থেকে খালি বাস পাঠাতে হচ্ছে। সেতুর টোল, মহাসড়কের টোল, বিভিন্ন চাঁদা ও তেল খরচ সমন্বয় করতে ভাড়া বেশি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য কিছুটা ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ মুঠোফোনে বলেন, বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। ঈদের সময় ভাড়া নির্ধারণের বিষয় শরীয়তপুর আন্তঃজেলা বাস ও মিনি বাস মালিক সমিতির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালাবেন ম্যাজিস্ট্রেট।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে নগরীর বিভিন্ন বাস স্টপেজ ও ৩টি টার্মিনালে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কোনো পরিবহন বাড়তি ভাড়া আদায় করলে এমন অভিযোগ পেলে কর্তব্যরত পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।













