০৮:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গলার কাটা বিআরটিএ প্রকল্প

  • ১৭ বছরে ব্যয় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা
  • ত্রুটিপূর্ণ নকশা অপেক্ষা বাড়ছে ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীদের
  • চালু করতে লাগবে আরও সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ও চার বছর

‘কিছু চলমান মেগাপ্রকল্প আছে, যেগুলো সরকার গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না।’ – ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা

ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীদের জন্য স্বস্তিদায়ক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুরু হওয়া বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প এখন হয়ে ওঠেছে একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের প্রতীক। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ একাধিকবার বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালেও পূর্ণতা পায়নি। বর্তমানে ৯৭.৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হলেও বিআরটি করিডোর চালু করার উপযোগী নয়, যার পেছনে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ নকশা, অপারেশন পরিকল্পনার ঘাটতি এবং বাস্তবায়নে চরম অব্যবস্থাপনা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পটি শেষ করতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি প্রকল্প। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষে অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখানো হয় ৯৭.৪৭ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে। যার মধ্য ২৫টি স্টেশন, একটি বাস ডিপো, সাতটি ফ্লাইওভার, ফুটপাথ ও ১৯টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। তবে বাস্তবে এর চিত্র অনেক আংশেই উল্টো। স্টেশনগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজেহাল। সময়সীমা ও ব্যয়ের দিক থেকে একের পর এক রেকর্ড গড়েছে প্রকল্পটি। ২০১২ থেকে ২০১৬ মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট নির্ধারিত হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় তা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচবার সময় বাড়িয়েও ২০২৪ সালে শেষ হয়নি প্রকল্পটি। যদিও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জানানো হয়, কাজ বাকি মাত্র দুই শতাংশ। এসময় ১০টি বিআরটিসি বাস দিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। এরপর ২০২৫ এর জুনে প্রকল্পটি পুরোদমে চালুর কথা থাকলেও তা তো হয়ইনি, উল্টো পাঁচ মাস পর বন্ধ হয়ে গেছে পাইলট প্রকল্পও। অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও জায়গা দখল করে গ্যারেজে কাজ করতেও দেখা যায় স্টেশেনে। চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প প্রয়োজন আরও তিন হাজার কোটি টাকা। যেখানে সপ্তম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়তে পারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা, যা প্রাথমিক বাজেটের তিনগুণ। পাশাপাশি সময়সীমাও বাড়িয়ে ২০২৯ সাল পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৭ বছরেও একটি সিটি করিডোরভিত্তিক গণপরিবহন প্রকল্প শেষ করা যাচ্ছে না।
বিআরটি প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০.৫ কিমি দীর্ঘ করিডোর নির্মাণের উদ্দেশ্য। শুরুতে এর বাজেট ছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এখন নতুন করে ৩ হাজার কোটি টাকার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ এককভাবে একটি গণপরিবহন প্রকল্পে ১৭ বছরের ব্যবধানে খরচ হতে যাচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
বিআরটির মূল অবকাঠামোগত কাজ ৯৭ শতাংশ শেষ হলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখন বলছে যাত্রী চলাচলের জন্য যেসব বাস, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্টেশন ব্যবস্থাপনা ও ভূমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন, তার অনেক কিছুই প্রকল্পের মূল নকশায় ছিল না। ফলে এসব অপারেশন-সম্পর্কিত অনুষঙ্গ যুক্ত করতে হচ্ছে নতুন করে।
ছাত্র আন্দোলনের সময় বিআরটি করিডোরের কিছু যন্ত্রাংশ ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। লিফট, এস্কেলেটর, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ স্টেশনগুলোর একটি অংশ ভাঙচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার জন্য ঠিকাদারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে প্রকল্পের দরপত্র হয়েছিল, তখনকার ব্যয়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। এছাড়া ছাত্র আন্দোলনের ক্ষতি ও নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করাও বড় ব্যয় বাড়ানোর কারণ। প্রকল্পটি শেষ না করলে পুরো বিনিয়োগটাই বৃথা যাবে। তাই আপাতত ব্যয় বাড়িয়েও এটি চালুর পথ খোঁজা হচ্ছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে বিআরটি করিডোরে ১০টি বাস দিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়, তবে তা পাঁচ মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। স্টেশন এলাকাগুলোতে অবৈধ পার্কিং, গ্যারেজে জায়গা দখল, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি প্রকল্পের অকার্যকারিতাকে সামনে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা বলছেন, সাইনবোর্ড আছে এখানে গাড়ি রাখা যাবে না কিন্তু কেউ দেখার নেই।
গত ১৮ মে আলোচিত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্প শেষ করতে আরো ৩ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। উপদেষ্টা বলেন, কিছু চলমান মেগাপ্রকল্প আছে, যেগুলো সরকার গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না। যেমন কর্ণফুলী টানেল হয়েছে। এই টানেল দিয়ে কোথায় যাবো? টাকা খরচ করে তারকামানের রিসোর্ট করা হয়েছে। ধু ধু প্রান্তর। ওখানে কারা যাবে? এছাড়া বিআরটি প্রকল্প শেষ করতে আরো তিন হাজার কোটি টাকা লাগবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গেল তিন বছরে ১৫ হাজার টন ই-বর্জ্য আমদানি

গলার কাটা বিআরটিএ প্রকল্প

আপডেট সময় : ০৭:৩৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
  • ১৭ বছরে ব্যয় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা
  • ত্রুটিপূর্ণ নকশা অপেক্ষা বাড়ছে ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীদের
  • চালু করতে লাগবে আরও সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ও চার বছর

‘কিছু চলমান মেগাপ্রকল্প আছে, যেগুলো সরকার গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না।’ – ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা

ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীদের জন্য স্বস্তিদায়ক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুরু হওয়া বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প এখন হয়ে ওঠেছে একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের প্রতীক। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ একাধিকবার বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালেও পূর্ণতা পায়নি। বর্তমানে ৯৭.৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হলেও বিআরটি করিডোর চালু করার উপযোগী নয়, যার পেছনে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ নকশা, অপারেশন পরিকল্পনার ঘাটতি এবং বাস্তবায়নে চরম অব্যবস্থাপনা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পটি শেষ করতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি প্রকল্প। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষে অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখানো হয় ৯৭.৪৭ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে। যার মধ্য ২৫টি স্টেশন, একটি বাস ডিপো, সাতটি ফ্লাইওভার, ফুটপাথ ও ১৯টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। তবে বাস্তবে এর চিত্র অনেক আংশেই উল্টো। স্টেশনগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজেহাল। সময়সীমা ও ব্যয়ের দিক থেকে একের পর এক রেকর্ড গড়েছে প্রকল্পটি। ২০১২ থেকে ২০১৬ মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট নির্ধারিত হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় তা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচবার সময় বাড়িয়েও ২০২৪ সালে শেষ হয়নি প্রকল্পটি। যদিও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জানানো হয়, কাজ বাকি মাত্র দুই শতাংশ। এসময় ১০টি বিআরটিসি বাস দিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। এরপর ২০২৫ এর জুনে প্রকল্পটি পুরোদমে চালুর কথা থাকলেও তা তো হয়ইনি, উল্টো পাঁচ মাস পর বন্ধ হয়ে গেছে পাইলট প্রকল্পও। অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও জায়গা দখল করে গ্যারেজে কাজ করতেও দেখা যায় স্টেশেনে। চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প প্রয়োজন আরও তিন হাজার কোটি টাকা। যেখানে সপ্তম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়তে পারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা, যা প্রাথমিক বাজেটের তিনগুণ। পাশাপাশি সময়সীমাও বাড়িয়ে ২০২৯ সাল পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৭ বছরেও একটি সিটি করিডোরভিত্তিক গণপরিবহন প্রকল্প শেষ করা যাচ্ছে না।
বিআরটি প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০.৫ কিমি দীর্ঘ করিডোর নির্মাণের উদ্দেশ্য। শুরুতে এর বাজেট ছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এখন নতুন করে ৩ হাজার কোটি টাকার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ এককভাবে একটি গণপরিবহন প্রকল্পে ১৭ বছরের ব্যবধানে খরচ হতে যাচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
বিআরটির মূল অবকাঠামোগত কাজ ৯৭ শতাংশ শেষ হলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখন বলছে যাত্রী চলাচলের জন্য যেসব বাস, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্টেশন ব্যবস্থাপনা ও ভূমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন, তার অনেক কিছুই প্রকল্পের মূল নকশায় ছিল না। ফলে এসব অপারেশন-সম্পর্কিত অনুষঙ্গ যুক্ত করতে হচ্ছে নতুন করে।
ছাত্র আন্দোলনের সময় বিআরটি করিডোরের কিছু যন্ত্রাংশ ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। লিফট, এস্কেলেটর, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ স্টেশনগুলোর একটি অংশ ভাঙচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার জন্য ঠিকাদারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে প্রকল্পের দরপত্র হয়েছিল, তখনকার ব্যয়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। এছাড়া ছাত্র আন্দোলনের ক্ষতি ও নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করাও বড় ব্যয় বাড়ানোর কারণ। প্রকল্পটি শেষ না করলে পুরো বিনিয়োগটাই বৃথা যাবে। তাই আপাতত ব্যয় বাড়িয়েও এটি চালুর পথ খোঁজা হচ্ছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে বিআরটি করিডোরে ১০টি বাস দিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়, তবে তা পাঁচ মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। স্টেশন এলাকাগুলোতে অবৈধ পার্কিং, গ্যারেজে জায়গা দখল, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি প্রকল্পের অকার্যকারিতাকে সামনে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা বলছেন, সাইনবোর্ড আছে এখানে গাড়ি রাখা যাবে না কিন্তু কেউ দেখার নেই।
গত ১৮ মে আলোচিত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্প শেষ করতে আরো ৩ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। উপদেষ্টা বলেন, কিছু চলমান মেগাপ্রকল্প আছে, যেগুলো সরকার গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না। যেমন কর্ণফুলী টানেল হয়েছে। এই টানেল দিয়ে কোথায় যাবো? টাকা খরচ করে তারকামানের রিসোর্ট করা হয়েছে। ধু ধু প্রান্তর। ওখানে কারা যাবে? এছাড়া বিআরটি প্রকল্প শেষ করতে আরো তিন হাজার কোটি টাকা লাগবে।