- তুরস্কের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আধুনিক অস্ত্র কারখানা
- প্রতিরক্ষা শিল্প ঘিরে নতুন ইকোসিস্টেমের প্রত্যাশা
- ঢাকায় কৌশলগত উপস্থিতি জোরদারের চেষ্টায় আঙ্কারা
- ঢাকায় আসছেন তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প প্রধান হালুক গরগুন
‘বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় প্রতিটি দেশই চায় প্রতিরক্ষা শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে। তবে তুরস্কের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের যে আলোচনা চলছে, দেশের স্বার্থ যেন অক্ষুণ্ন থাকে তা নিশ্চিত করা জরুরি।’ – মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মনিরুজ্জামান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
‘তুরস্কের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে সেই সহযোগিতা বিস্তৃত হতেই পারে। তবে জাতীয় স্বার্থ যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয় তা অবশ্যই দেখতে হবে।’ – এম হুমায়ুন কবীর, সাবেক রাষ্ট্রদূত
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হালুক গরগুন আগামীকাল ঢাকায় আসছেন। ২৪ ঘণ্টার স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তার এই সফরকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে বড় ধরনের অগ্রগতির বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তুরস্কের সহযোগিতায় বাংলাদেশে আধুনিক অস্ত্র কারখানা গঠনের উদ্যোগ ইতিমধ্যেই বেশ অগ্রসর হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফরের মাধ্যমে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নে নতুন গতি আসবে।
তুরস্ক অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। ইতোমধ্যে ড্রোন, রাডার ও বর্মযুক্ত যানসহ বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে আমদানি করেছে। এবার আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে যৌথভাবে আধুনিক অস্ত্র কারখানা স্থাপন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কারখানার জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ করবে, আর নারায়ণগঞ্জে দক্ষ শ্রমশক্তি সহজলভ্য হবে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। জানা গেছে, সফরকালে হালুক গরগুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়াও তিনি পৃথক বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তুরস্কের প্রভাব বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আঙ্কারা ঢাকায় তাদের কৌশলগত উপস্থিতি জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিজস্ব প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির পাশাপাশি রপ্তানির লক্ষ্যে দুটি প্রতিরক্ষা শিল্প কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে চাইছে, যেখানে তুরস্ককে প্রযুক্তিগত ও বিনিয়োগ সহযোগী হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে দুটি প্রতিরক্ষা শিল্পাঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে তুরস্কের একাধিক প্রতিরক্ষা কোম্পানিকে পার্টনার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে সম্প্রতি বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান তুরস্ক সফরে পাঁচদিনের একটি কর্মসূচি সম্পন্ন করেছেন। এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত অ্যান্টালিয়া ডিপ্লোমেসি ফোরামে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য অ্যারোস্পেস অংশীদার প্রয়োজন। আর তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা হলে সেটি হবে দুই দেশের জন্যই লাভজনক।
বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্ক এখন একটি উদীয়মান শক্তি। দেশটি নিজস্ব প্রযুক্তিতে ড্রোন, ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডারসহ নানা সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। বাংলাদেশ সেই অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে চায়। অস্ত্র কারখানা স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে ইতোমধ্যেই কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। এই প্রকল্প তদারকিতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। কারখানার প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, মানবসম্পদ, উৎপাদন পরিকল্পনা এবং রপ্তানি কৌশল সুপরিকল্পিতভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে যৌথভাবে তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি এবং কমান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ে গবেষণার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে এই গবেষণা কাঠামো গড়ে তোলা হতে পারে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর প্রেসিডেন্ট আশিক চৌধুরী এরই মধ্যে তুর্কি প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। আলোচনায় বিনিয়োগ, অবকাঠামো সুবিধা, কর অবকাশ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং দক্ষ জনবল গঠনের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। সূত্র জানায়, বিডা এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা দেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তুরস্কের সহযোগিতায় অস্ত্র কারখানা তৈরির বিষয়টি হালুক গরগুনের সফরে আলোচিত হবে। বাংলাদেশ এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে পশ্চিমা দেশ, চীন, ভারত এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। তুরস্কের সঙ্গে এই উদ্যোগ সেই নীতির অংশ। শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা সংলাপ এবং গবেষণাও এই সহযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের ভেতরেই একটি প্রতিরক্ষা শিল্পনির্ভর ইকোসিস্টেম গড়ে উঠতে পারে। অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরি, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা সফটওয়্যার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন খাতে নতুন শিল্প স্থাপন এবং কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষায় আগ্রহী তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় প্রতিটি দেশই চায় প্রতিরক্ষা শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে। তবে তুরস্কের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের যে আলোচনা চলছে, তার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন না দেখে কিছু বলা ঠিক হবে না। দেশের স্বার্থ যেন অক্ষুণ্ন থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, তুরস্কের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে সেই সহযোগিতা বিস্তৃত হতেই পারে। তবে জাতীয় স্বার্থ যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয় তা অবশ্যই দেখতে হবে।













