০৭:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাজধানীতে অটোরিকশার বেপরোয়া দৌড়

আজিমপুরে অটোরিকশার ধাক্কায় সবুজ বাংলার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আহত

রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে অটোরিকশার দৌড় এখন যেন এক অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। যত্রতত্র চলাচল, বেপরোয়া গতি আর ড্রাইভারদের মধ্যে ‘কে আগে যাবে’ প্রতিযোগিতা এখন নাগরিক জীবনের স্থায়ী আতঙ্কে দাঁড়িয়েছে।

আজ (সোমবার) বেলা আড়াইটায় দিকে রাজধানীর আজিমপুরে এমনই এক ঘটনায় আহত হয়েছেন সবুজ বাংলার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শামসুর রহমান। তিনি অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি অটোরিকশা তাকে চাপা দেয়। এতে তিনি আহত হন। ঘটনার সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পেছনের একটি অটো সামনের অটোকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থাকা পথচারী শামসুর রহমানকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি সড়কে ছিটকে পড়ে আহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ ফার্মেসিতে নিয়ে যান। এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।

প্রত্যক্ষদর্শী অপর এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, “এই এলাকায় অটোগুলা দৌড়ায় পাগলের মতো। একে অন্যকে পেছনে ফেলতে গিয়ে কখন কার গায়ে লাগে বলা যায় না। পুলিশ সামান্যই ব্যবস্থা নেয়।”

সাংবাদিক শামসুর রহমান জানান, তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি বলেন, “আমি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম, তখন দেখি দুইটা অটোরিকশা গতি তুলছে। হঠাৎ একটার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার দিকে চলে আসে। মুহূর্তের মধ্যে কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় এখনো মাথা আর হাতে ব্যথা করছে,” তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে অটোরিকশা এখন শুধু গণপরিবহন নয়, বরং অনেকটা ‘ঝুঁকিপূর্ণ যান’ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

 

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই অটোরিকশা জড়িত দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৭০০টিরও বেশি, যেখানে নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক পথচারী ও যাত্রী। অধিকাংশ চালকেরই নেই সঠিক লাইসেন্স, প্রশিক্ষণ বা সড়ক-নিয়ম সম্পর্কে ধারণা। তাছাড়া প্রতিযোগিতা আর যাত্রী তোলার লোভে তারা যানবাহনের গতি বাড়িয়ে বেপরোয়া চালান, ফলে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।

অটোরিকশার এই বিশৃঙ্খল চলাচলের কারণে শুধু দুর্ঘটনাই নয়, রাস্তা পারাপারও এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে স্কুল–কলেজগামী শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। আজিমপুর, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র দেখা যায়—অটোরিকশাগুলো লেন ভেঙে বিপরীতমুখী চলাচল করে, কোনো নিয়ম–শৃঙ্খলার বালাই নেই।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চার্জিং ব্যবস্থাও অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব যানবাহনের ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অননুমোদিতভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়া হয়। এতে একদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, অন্যদিকে অবৈধ সংযোগের কারণে প্রায়ই ঘটে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ড। বিদ্যুৎ বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের একাধিক অভিযানে দেখা গেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গ্যারেজের ভেতরেই অনুমোদনহীন তার টেনে রাখা হয় ব্যাটারি চার্জের জন্য, যা জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ইউনিয়নের রাজনৈতিক নেতারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, ফলে আইন প্রয়োগ কঠিন হয়ে যায়। নিয়মিত অভিযান চললেও যথাযথ রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্সবিহীন অটোরিকশার সংখ্যা এখনো বিপুল।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোরিকশা নগর পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর বেপরোয়া চলাচল ও অব্যবস্থাপনা এখন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের মতে, এসব যান নির্দিষ্ট রুটে সীমাবদ্ধ রাখা, চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।

ঘটনার পর সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে দোষী চালকের শাস্তি ও অটোরিকশার বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছে। সবুজ বাংলা সম্পাদকীয় বোর্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, “রাজধানীর সড়কে যে অনিয়ম চলছে তা এখনই বন্ধ না করলে আরও অনেক প্রাণহানি ঘটবে। শামসুর রহমানের মতো অনেক পথচারী প্রতিদিন এমন ঝুঁকিতে থাকেন।”

এ অবস্থায় নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এসব অটোরিকশা শুধু অনুমোদনহীন নয়, বরং অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে চার্জ নিয়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে এবং অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি করছে। সময়মতো কঠোর সিদ্ধান্ত না নিলে রাজধানীর যানবাহন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

জামালপুর-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক প্রেসক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

রাজধানীতে অটোরিকশার বেপরোয়া দৌড়

আজিমপুরে অটোরিকশার ধাক্কায় সবুজ বাংলার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আহত

আপডেট সময় : ০৫:১৬:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে অটোরিকশার দৌড় এখন যেন এক অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। যত্রতত্র চলাচল, বেপরোয়া গতি আর ড্রাইভারদের মধ্যে ‘কে আগে যাবে’ প্রতিযোগিতা এখন নাগরিক জীবনের স্থায়ী আতঙ্কে দাঁড়িয়েছে।

আজ (সোমবার) বেলা আড়াইটায় দিকে রাজধানীর আজিমপুরে এমনই এক ঘটনায় আহত হয়েছেন সবুজ বাংলার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শামসুর রহমান। তিনি অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি অটোরিকশা তাকে চাপা দেয়। এতে তিনি আহত হন। ঘটনার সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পেছনের একটি অটো সামনের অটোকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থাকা পথচারী শামসুর রহমানকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি সড়কে ছিটকে পড়ে আহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ ফার্মেসিতে নিয়ে যান। এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।

প্রত্যক্ষদর্শী অপর এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, “এই এলাকায় অটোগুলা দৌড়ায় পাগলের মতো। একে অন্যকে পেছনে ফেলতে গিয়ে কখন কার গায়ে লাগে বলা যায় না। পুলিশ সামান্যই ব্যবস্থা নেয়।”

সাংবাদিক শামসুর রহমান জানান, তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি বলেন, “আমি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম, তখন দেখি দুইটা অটোরিকশা গতি তুলছে। হঠাৎ একটার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার দিকে চলে আসে। মুহূর্তের মধ্যে কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় এখনো মাথা আর হাতে ব্যথা করছে,” তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে অটোরিকশা এখন শুধু গণপরিবহন নয়, বরং অনেকটা ‘ঝুঁকিপূর্ণ যান’ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

 

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই অটোরিকশা জড়িত দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৭০০টিরও বেশি, যেখানে নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক পথচারী ও যাত্রী। অধিকাংশ চালকেরই নেই সঠিক লাইসেন্স, প্রশিক্ষণ বা সড়ক-নিয়ম সম্পর্কে ধারণা। তাছাড়া প্রতিযোগিতা আর যাত্রী তোলার লোভে তারা যানবাহনের গতি বাড়িয়ে বেপরোয়া চালান, ফলে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।

অটোরিকশার এই বিশৃঙ্খল চলাচলের কারণে শুধু দুর্ঘটনাই নয়, রাস্তা পারাপারও এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে স্কুল–কলেজগামী শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। আজিমপুর, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র দেখা যায়—অটোরিকশাগুলো লেন ভেঙে বিপরীতমুখী চলাচল করে, কোনো নিয়ম–শৃঙ্খলার বালাই নেই।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চার্জিং ব্যবস্থাও অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব যানবাহনের ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অননুমোদিতভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়া হয়। এতে একদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, অন্যদিকে অবৈধ সংযোগের কারণে প্রায়ই ঘটে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ড। বিদ্যুৎ বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের একাধিক অভিযানে দেখা গেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গ্যারেজের ভেতরেই অনুমোদনহীন তার টেনে রাখা হয় ব্যাটারি চার্জের জন্য, যা জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ইউনিয়নের রাজনৈতিক নেতারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, ফলে আইন প্রয়োগ কঠিন হয়ে যায়। নিয়মিত অভিযান চললেও যথাযথ রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্সবিহীন অটোরিকশার সংখ্যা এখনো বিপুল।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোরিকশা নগর পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর বেপরোয়া চলাচল ও অব্যবস্থাপনা এখন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের মতে, এসব যান নির্দিষ্ট রুটে সীমাবদ্ধ রাখা, চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।

ঘটনার পর সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে দোষী চালকের শাস্তি ও অটোরিকশার বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছে। সবুজ বাংলা সম্পাদকীয় বোর্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, “রাজধানীর সড়কে যে অনিয়ম চলছে তা এখনই বন্ধ না করলে আরও অনেক প্রাণহানি ঘটবে। শামসুর রহমানের মতো অনেক পথচারী প্রতিদিন এমন ঝুঁকিতে থাকেন।”

এ অবস্থায় নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এসব অটোরিকশা শুধু অনুমোদনহীন নয়, বরং অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে চার্জ নিয়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে এবং অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি করছে। সময়মতো কঠোর সিদ্ধান্ত না নিলে রাজধানীর যানবাহন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এমআর/সবা