- ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগী চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত
- প্রতিরোধে দায় আছে নাগরিকদেরও
- সতর্কতা ও সচেতনতাই বড় ওষুধ
‘গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে’ -অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন, পরিচালক, আইইডিসিআর
‘এগুলোর দেশে কোনো চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি জরুরি। প্রশাসন ও জনগণ মিলে সবার সমন্বিত পদক্ষেপে মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের রেহাই নেই’ -ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, ইমেরিটাস অধ্যাপক
করোনা আর ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মধ্যেই নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টে নতুন করে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি এবং ডেঙ্গুর মৌসুমের আগেই ভয়াবহতা বৃদ্ধির মধ্যেই চিকুনগুনিয়া ভোগাতে শুরু করায় বিপাকে দেশের স্বাস্থ্য খাত। এ বছর সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। যা স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট সবাইকেই শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। একদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ, অন্যদিকে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের হানার মধ্যে চিকুনগুনিয়ার এমন প্রভাব নিয়ে ঘোর সংকটের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর এক পরীক্ষাতেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে, যা অনেক শঙ্কার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোর দেশে কোনো চিকিৎসা নেই। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি জরুরি। প্রশাসন ও জনগণ মিলে সবার সমন্বিত পদক্ষেপে মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে রেহাই নেই বলেও শঙ্কা তাদের।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) তাদের গবেষণায় জানিয়েছে, এ বছর সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। এদিকে, রাজধানী ঢাকার ১৩ ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর বিস্তার সবচেয়ে বেশি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চালানো ‘মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে ২০২৫’ জরিপে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। এর বাইরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং দেশের আরও ৮টি জেলায় ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপ সম্পন্ন করে আইইডিসিআর। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও জরিপের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং কুষ্টিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ ও মাগুরা পৌরসভা এলাকায়।
গবেষণার জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত এলাকাগুলোর ৩ হাজার ১৪৭টি বাসাবাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মোট ৪৬৩টি বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া গেছে। ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টির বিভিন্ন এলাকায় ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। উভয় সিটিতেই এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে, যা ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়া ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে, একক বাড়িতে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেমিপাকা বাড়িতে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ফাঁকা স্থানে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে ফুলের টব ও ট্রেতে জমে থাকা পানিতে। জরিপে পাওয়া মোট লার্ভার ২৭ শতাংশই বসবাস করে এসব পানিতে। এছাড়া ২২ শতাংশ সিমেন্ট নির্মিত পানির ট্যাংকে, ২০ শতাংশ ফ্লোরে জমে থাকা পানিতে, ১৩ শতাংশ প্লাস্টিকের ড্রামে, ১১ শতাংশ লোহার পাইপে, ১০ শতাংশ প্লাস্টিকের পাত্রে এডিসের লার্ভা পেয়েছেন গবেষকেরা। জেলা পর্যায়েও চলছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত দেশে চার হাজার ৬৬০ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ৩৮৭ জন। এ সময়ে করোনায় মারা গেছেন সাতজন। ১৯ জুনের তথ্যে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায়ও দেশে নতুন করে ৩৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আগের দিন ১৮ জুনও শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৮ জন। অন্যদিকে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৯২৬ জন। তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩০ জন মারা গেছেন। এদিকে, চলতি বছর হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। চিকুনগুনিয়ার বিষয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ রোগীর কিন্তু ঘরে বসেই চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। প্যারাসিটামলের বাইরে কোনো ওষুধ খাবেন না। বেশি বেশি লিকুইড খেতে হবে। আর যদি খেতে না পারলে, বমি হয়, পাতলা পায়খানা হয়, অথবা যাদের অন্য রোগ আছে; ডায়াবেটিকস, হাইপেশার, কিডনি, লিভার ও ক্যান্সারের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে ভালো। বয়স্ক, ছোট বাচ্চা ও নারীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে বলেও জানাচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর এক পরীক্ষাতেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। আমরা গত বছর জিকা ভাইরাস পজেটিভ রোগী পেলেও এবছর এখনো পাইনি। তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জাগো, ডেঙ্গু হচ্ছে, চিকুনগুনিয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে করোনাও শনাক্ত হচ্ছে। সবই তো ভাইরাস। এগুলোর দেশে কোনো চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া হয় এডিস মশা থেকে। প্রশাসন ও জনগণ মিলে সবার সমন্বিত পদক্ষেপে মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের রেহাই নেই। যে হারে প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, সামনে হয়তো আরও বাড়বে।

























