০৯:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উপকূলের কিশোরীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে

  • ৭২ শতাংশ কিশোরীর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি
    ৬৫ শতাংশ কিশোরী আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে
    ৫৪ শতাংশ কিশোরীর শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি
    ৭৪ শতাংশ কিশোরী ফল বা দুধজাত খাদ্য পাচ্ছে না

    বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাছ চাষের অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী পরিবারের ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ইন অ্যাকুয়াকালচার ইকোজোন্স অ্যাট রিস্ক অব নিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সিস’ শিরোনামে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস (পাবমেড সেন্ট্রাল)-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
    গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ কিশোরীর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি রয়েছে। ৬৫ শতাংশ কিশোরী আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে আর ৫৪ শতাংশ কিশোরীর শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি ধরা পড়েছে, যা থাইরয়েড সমস্যা এবং মানসিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। গবেষণা বলছে, সমুদ্র অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষত নারীরা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তারা নিজেরা চাষ করা মাছ খেতে পারে না। পরিবারগুলোর খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মাছ থাকলেও তা একঘেয়ে, প্রধানত ইলিশ, রুই, তেলাপিয়া— যা পুষ্টিবৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।
    লবণাক্ততা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ধান, ডাল, শাকসবজি উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। ফলে মাছ থাকলেও, খাবারে শাক, ডাল, দুধ বা ডিম থাকে না বললেই চলে। এ কারণেই খাদ্য তালিকা একমুখী হয়ে গেছে বলছেন গবেষকরা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) ২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, উপকূলীয় ৬টি জেলায় গত এক দশকে ডাল ও শাকসবজির জমি ৩০ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে ধনেপাতা, লালশাক, পালংশাক ও কাঁচামরিচের মতো মৌলিক সবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সয়েল রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (এসআডিআই) ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলে ২০৫০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন ১৫.৬ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে মাটির লবণাক্ততা ছিল ৪.৫ ডেসিসিমেন্স/মিটার, ২০২৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৯ ডেসিসিমেন্স/মিটার। গবেষকরা বলছেন, এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। খুলনার দাকোপ এলাকার কৃষক আব্দুল্লাহ নেসাউন আগে বছরে দুইবার ধান, শীতকালে ডাল আর শাক তুলতেন। এখন তিনি মাছ চাষে ঝুঁকেছেন, কেননা লবণাক্ততার কারণে তার জমিতে এখন ফসল হচ্ছে না। আফসোস করে এই কৃষক বলেন, আগে ফসল উঠত, বাজারে সবজি কিনতাম। এখন নিজের পুকুরে মাছ আছে ঠিকই কিন্তু পাতেও ভাত-মাছ ছাড়া কিছু নেই। ধান বিজ্ঞানী ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক ড. নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দিনকে দিন উপকূলে বাড়ছে লবণাক্ততা, যা ফসলি জমিতে আঘাত হানছে। যে কারণে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। এ সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। মাছচাষ এলাকায় বসবাসকারী পরিবারের ৬০ শতাংশ নারী ও শিশুর মধ্যে আয়রন ও আয়োডিন ঘাটতি রয়েছে, বলছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন)-এর ২০২২ সালের যৌথ প্রতিবেদন। পুষ্টিবিদ সামিনা জামান কাজরী বলেন, আমাদের দেশের নারীরা ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে; বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’ ও ‘সি’। শুধু মাছে কখনো সম্পূর্ণ পুষ্টি পাওয়া সম্ভব না। সঙ্গে দরকার কার্বোহাইড্রেট খাদ্য, যেমন ডাল, শাক, সবজি, মাংস ও দুধ জাতীয় খাবার। উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা, পানির সংকট ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে দুধ উৎপাদনকারী গবাদিপশুর খাদ্য সংকট, রোগব্যাধি ও মৃত্যুর হার বেড়েছে, যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই এসব এলাকায় দুধ জাতীয় খাবারে দেখা দিয়েছে পুষ্টি ঘাটতি। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই)/পাবমেড-এর ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপকূলে ‘টেম্পারেচার-হিউমিডিটি ইনডেক্স (টিএইচআই) ৭৪৯০ এর মধ্যে থাকে, যা গবাদিপশুর জন্য বিপজ্জনক। এতে পশুদের খাবারের চাহিদা কমে যায়, দুধ উৎপাদন কমে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষক শাফায়েত বলেন, আমাদের যে গাভী আগে এক-দুই কেজি দুধ দিতো, এখন সেই গাভী এক পোয়া দুধ দেয়। দুধ হবে কী করে? গাভী তো সবুজ ঘাস পায় না। আগে বর্ষাকালে মাঠে হাঁটুসমান দুর্বাঘাস হতো। এখন আর সেই ঘাস জন্মায় না। আগে এমন সময় ঘাসের মধ্যে জোঁক দেখা যেত। এখন জোকও দেখা যায় না। দেশি জাতের গাভীতে কেন দুধ হচ্ছে না, এমন প্রশ্নে ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়ে এলাকার মো. সবুজ বলেন, আমাদের এখন আর গাভীর আগের মতো দুধ হয় না। গরু সবুজ ঘাস পায় না। ফলে গরুগুলোকে দানাদার খাবার বেশি খাওয়াতে হয়। একটা গাভীতে সর্বোচ্চ তিন পোয়া দুধ হয়, যা বাছুরের দরকার হয়। যে কারণে গাভী থেকে এখন আর দুধ দোয়ানো হয় না। ২০২৩ সালে সার্ক জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার-এর গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পশুর জন্য উপযোগী খোরাকি চারা উৎপাদন ৩০-৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মাঠ পর্যায়ের খামারিরা জানান, আগে মহিষ দিনে ৬-৭ লিটার দুধ দিত, এখন সেটা ২-৩ লিটারে নেমে এসেছে। গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশে গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে পশুর স্বাভাবিক খাবারে ব্যাঘাত ঘটছে, যে কারণে দুধ ও মাংস উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ কমেছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিসম্পদ, পুষ্টি, জেনেটিক্স ও প্রজনন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. আল-নূর মো. ইফতেখার রহমান বলেন, উপকূলে কমেছে চারণভূমি। লবণাক্ততার কারণে ঘাসের মান কমেছে এবং এসব অঞ্চলে মাটিতে ঘাস চাষ করার সেই উর্বরতা নেই। এসব কারণে প্রাণীর খাদ্যে ব্যাঘাত ঘটছে আর এটাই মানুষের খাবারের প্রোটিন উৎসকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের পশু খামারিদের এখনও সেই বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ নেই, যাতে তারা পশু খাবার উৎপাদনে সহায়ক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তবে এখনই দুগ্ধ দেওয়া প্রাণীর স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিশ্চিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে এ সংকট আরও গভীর হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।
    গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোরীদের ৭৪ শতাংশ প্রতিদিন ভাত-মাছ খেলেও সবজি, ফল বা দুধজাত খাদ্য পাচ্ছে না। মাছের মধ্যে যেসব ভিটামিন থাকে, যেমন ভিটামিন ‘ডি’ বা আয়োডিন, তা যদি একই ধরনের মাছ নিয়মিত খাওয়া হয়, তাহলে চাহিদা পূরণ হয় না। পরিবারে প্রাধান্য থাকে পুরুষদের। গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম বা ফল থাকলেও তা আগে বাবার বা ভাইয়ের জন্য সংরক্ষিত থাকে। কিশোরীরা পাচ্ছে উচ্ছিষ্ট অংশ। ১৪ বছর বয়সী শিমু, বাগেরহাটের চিংড়িচাষি পরিবারের সদস্য। গাল ফোলা, শরীরে ক্লান্তি, মাসিকের সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। স্কুলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। শিমু বলে, আমরা মাছ চাষ করি ঠিকই কিন্তু নিজেরাই খেতে পারি না। মা বলেন, এই মাছ বিক্রি করে চাল কিনতে হবে। পুষ্টিবিদ সামিনা জামান কাজরী বলেন, আমাদের দেশের নারীরা সংসারে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। পরিবারের সবার খেয়াল রাখলেও নারী নিজে কখনো পরিপূর্ণ পুষ্টি পায় না। এমনকি ছেলে শিশুর তুলনায় কন্যা শিশুরাও খাবারের দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়। আর তাই কিশোর বয়স থেকে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকে কিশোরীরা।

জনপ্রিয় সংবাদ

উপকূলের কিশোরীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে

আপডেট সময় : ০৭:২০:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • ৭২ শতাংশ কিশোরীর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি
    ৬৫ শতাংশ কিশোরী আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে
    ৫৪ শতাংশ কিশোরীর শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি
    ৭৪ শতাংশ কিশোরী ফল বা দুধজাত খাদ্য পাচ্ছে না

    বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাছ চাষের অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী পরিবারের ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ইন অ্যাকুয়াকালচার ইকোজোন্স অ্যাট রিস্ক অব নিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সিস’ শিরোনামে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস (পাবমেড সেন্ট্রাল)-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
    গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ কিশোরীর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি রয়েছে। ৬৫ শতাংশ কিশোরী আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে আর ৫৪ শতাংশ কিশোরীর শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি ধরা পড়েছে, যা থাইরয়েড সমস্যা এবং মানসিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। গবেষণা বলছে, সমুদ্র অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষত নারীরা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তারা নিজেরা চাষ করা মাছ খেতে পারে না। পরিবারগুলোর খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মাছ থাকলেও তা একঘেয়ে, প্রধানত ইলিশ, রুই, তেলাপিয়া— যা পুষ্টিবৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।
    লবণাক্ততা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ধান, ডাল, শাকসবজি উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। ফলে মাছ থাকলেও, খাবারে শাক, ডাল, দুধ বা ডিম থাকে না বললেই চলে। এ কারণেই খাদ্য তালিকা একমুখী হয়ে গেছে বলছেন গবেষকরা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) ২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, উপকূলীয় ৬টি জেলায় গত এক দশকে ডাল ও শাকসবজির জমি ৩০ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে ধনেপাতা, লালশাক, পালংশাক ও কাঁচামরিচের মতো মৌলিক সবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সয়েল রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (এসআডিআই) ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলে ২০৫০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন ১৫.৬ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে মাটির লবণাক্ততা ছিল ৪.৫ ডেসিসিমেন্স/মিটার, ২০২৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৯ ডেসিসিমেন্স/মিটার। গবেষকরা বলছেন, এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। খুলনার দাকোপ এলাকার কৃষক আব্দুল্লাহ নেসাউন আগে বছরে দুইবার ধান, শীতকালে ডাল আর শাক তুলতেন। এখন তিনি মাছ চাষে ঝুঁকেছেন, কেননা লবণাক্ততার কারণে তার জমিতে এখন ফসল হচ্ছে না। আফসোস করে এই কৃষক বলেন, আগে ফসল উঠত, বাজারে সবজি কিনতাম। এখন নিজের পুকুরে মাছ আছে ঠিকই কিন্তু পাতেও ভাত-মাছ ছাড়া কিছু নেই। ধান বিজ্ঞানী ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক ড. নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দিনকে দিন উপকূলে বাড়ছে লবণাক্ততা, যা ফসলি জমিতে আঘাত হানছে। যে কারণে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। এ সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। মাছচাষ এলাকায় বসবাসকারী পরিবারের ৬০ শতাংশ নারী ও শিশুর মধ্যে আয়রন ও আয়োডিন ঘাটতি রয়েছে, বলছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন)-এর ২০২২ সালের যৌথ প্রতিবেদন। পুষ্টিবিদ সামিনা জামান কাজরী বলেন, আমাদের দেশের নারীরা ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে; বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’ ও ‘সি’। শুধু মাছে কখনো সম্পূর্ণ পুষ্টি পাওয়া সম্ভব না। সঙ্গে দরকার কার্বোহাইড্রেট খাদ্য, যেমন ডাল, শাক, সবজি, মাংস ও দুধ জাতীয় খাবার। উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা, পানির সংকট ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে দুধ উৎপাদনকারী গবাদিপশুর খাদ্য সংকট, রোগব্যাধি ও মৃত্যুর হার বেড়েছে, যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই এসব এলাকায় দুধ জাতীয় খাবারে দেখা দিয়েছে পুষ্টি ঘাটতি। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই)/পাবমেড-এর ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপকূলে ‘টেম্পারেচার-হিউমিডিটি ইনডেক্স (টিএইচআই) ৭৪৯০ এর মধ্যে থাকে, যা গবাদিপশুর জন্য বিপজ্জনক। এতে পশুদের খাবারের চাহিদা কমে যায়, দুধ উৎপাদন কমে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষক শাফায়েত বলেন, আমাদের যে গাভী আগে এক-দুই কেজি দুধ দিতো, এখন সেই গাভী এক পোয়া দুধ দেয়। দুধ হবে কী করে? গাভী তো সবুজ ঘাস পায় না। আগে বর্ষাকালে মাঠে হাঁটুসমান দুর্বাঘাস হতো। এখন আর সেই ঘাস জন্মায় না। আগে এমন সময় ঘাসের মধ্যে জোঁক দেখা যেত। এখন জোকও দেখা যায় না। দেশি জাতের গাভীতে কেন দুধ হচ্ছে না, এমন প্রশ্নে ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়ে এলাকার মো. সবুজ বলেন, আমাদের এখন আর গাভীর আগের মতো দুধ হয় না। গরু সবুজ ঘাস পায় না। ফলে গরুগুলোকে দানাদার খাবার বেশি খাওয়াতে হয়। একটা গাভীতে সর্বোচ্চ তিন পোয়া দুধ হয়, যা বাছুরের দরকার হয়। যে কারণে গাভী থেকে এখন আর দুধ দোয়ানো হয় না। ২০২৩ সালে সার্ক জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার-এর গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পশুর জন্য উপযোগী খোরাকি চারা উৎপাদন ৩০-৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মাঠ পর্যায়ের খামারিরা জানান, আগে মহিষ দিনে ৬-৭ লিটার দুধ দিত, এখন সেটা ২-৩ লিটারে নেমে এসেছে। গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশে গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে পশুর স্বাভাবিক খাবারে ব্যাঘাত ঘটছে, যে কারণে দুধ ও মাংস উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ কমেছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিসম্পদ, পুষ্টি, জেনেটিক্স ও প্রজনন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. আল-নূর মো. ইফতেখার রহমান বলেন, উপকূলে কমেছে চারণভূমি। লবণাক্ততার কারণে ঘাসের মান কমেছে এবং এসব অঞ্চলে মাটিতে ঘাস চাষ করার সেই উর্বরতা নেই। এসব কারণে প্রাণীর খাদ্যে ব্যাঘাত ঘটছে আর এটাই মানুষের খাবারের প্রোটিন উৎসকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের পশু খামারিদের এখনও সেই বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ নেই, যাতে তারা পশু খাবার উৎপাদনে সহায়ক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তবে এখনই দুগ্ধ দেওয়া প্রাণীর স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিশ্চিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে এ সংকট আরও গভীর হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।
    গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোরীদের ৭৪ শতাংশ প্রতিদিন ভাত-মাছ খেলেও সবজি, ফল বা দুধজাত খাদ্য পাচ্ছে না। মাছের মধ্যে যেসব ভিটামিন থাকে, যেমন ভিটামিন ‘ডি’ বা আয়োডিন, তা যদি একই ধরনের মাছ নিয়মিত খাওয়া হয়, তাহলে চাহিদা পূরণ হয় না। পরিবারে প্রাধান্য থাকে পুরুষদের। গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম বা ফল থাকলেও তা আগে বাবার বা ভাইয়ের জন্য সংরক্ষিত থাকে। কিশোরীরা পাচ্ছে উচ্ছিষ্ট অংশ। ১৪ বছর বয়সী শিমু, বাগেরহাটের চিংড়িচাষি পরিবারের সদস্য। গাল ফোলা, শরীরে ক্লান্তি, মাসিকের সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। স্কুলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। শিমু বলে, আমরা মাছ চাষ করি ঠিকই কিন্তু নিজেরাই খেতে পারি না। মা বলেন, এই মাছ বিক্রি করে চাল কিনতে হবে। পুষ্টিবিদ সামিনা জামান কাজরী বলেন, আমাদের দেশের নারীরা সংসারে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। পরিবারের সবার খেয়াল রাখলেও নারী নিজে কখনো পরিপূর্ণ পুষ্টি পায় না। এমনকি ছেলে শিশুর তুলনায় কন্যা শিশুরাও খাবারের দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়। আর তাই কিশোর বয়স থেকে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকে কিশোরীরা।