চলতি বছরে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ১৭৯, আক্রান্ত ১ হাজার ১৬১
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হিসাব নেই চিকুনগুনিয়ার
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। জ্বর, শরীর ব্যথা ও অস্বাভাবিক দুর্বলতায় নাজেহাল মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। শয্যা সংকটের কারণে অনেককে মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ গেছে ১৭৯ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে মারা গেছেন ৪ জন এবং ভর্তি হয়েছেন ৮৪৫ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ১৬১ জন রোগী। কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথিতে এ রোগের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘাটতি বাস্তব পরিস্থিতিকে আড়াল করছে।

দেশের প্রায় প্রতিটি শহরেই এখন জ্বরে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ভাইরাল জ্বর। অনেক পরিবারেই একসঙ্গে একাধিক সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ভুক্তভোগী নার্গিস বেগমের অভিজ্ঞতা এ পরিস্থিতিরই প্রতিচ্ছবি। মায়ের কুলখানীতে অংশ নিতে গিয়ে মুন্সিগঞ্জের গ্রামে অবস্থানকালে তিনি ও পরিবারের আরও কয়েকজন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রথমে স্থানীয় ফার্মেসির ওষুধে কিছুটা আরাম মিললেও দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হয়। ঢাকায় ফিরে হাসপাতালে পরীক্ষায় তাদের মধ্যে কারও দেহে ডেঙ্গু, কারও দেহে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। নার্গিস বলেন, “জ্বরটা যেন হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে যায়। হাসপাতালে থাকাকালে পরিবারের সদস্যরা কেঁদে ভেঙে পড়েছিলেন। মনে হচ্ছিল মশার কামড়ে শুধু আমরা নই, গোটা বাংলাই কাঁদছে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক। বছরের শুরু থেকেই তারা সতর্ক করে আসছিলেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত মশক নিধন হয়নি। শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আক্রান্তদের অনেকেই দেরিতে হাসপাতালে আসেন। এতে জটিলতা বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, রোগীরা দ্রুত পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিলে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। জনগণকে সচেতন না করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসকরা দাবি করেছেন, তারা নিয়মিত মশক নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পানি জমতে না দেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাদেরও স্বীকারোক্তি, জনসচেতনতা ছাড়া কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ এক হাজারের বেশি মানুষ, মারা যান ৫৭৫ জন। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন লাখেরও বেশি, আর প্রাণ হারিয়েছিলেন এক হাজার ৭০০ জনের বেশি। ২০২৫ সালের শুরু থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। জানুয়ারিতে যেখানে আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ১ হাজার ১৬১ জন, সেপ্টেম্বরে এসে এ সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশজুড়ে যখন ঘরে ঘরে মানুষ জ্বরে কাতরাচ্ছে, তখন কার্যকর মশক নিধন ও জনগণের সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা ছোট হলেও এর কামড়ে গোটা জাতির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও জনজীবন কেঁপে উঠছে। তাই এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
এমআর/সবা

























