রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে তেজপাতা। একসময় পরিবারের রান্নাঘরের চাহিদা মেটাতে বাড়ির আঙিনায় লাগানো হতো কয়েকটি তেজপাতার গাছ। এখন সেটিই হয়ে উঠেছে আয়ের বড় উৎস। উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের বাজেমজকুর, চৈতারমোড়, রাজীবসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে তেজপাতার সবুজ বাগানই এখন চোখে পড়ে।
ধান ও পাট চাষে লোকসান গুনে কৃষকরা যখন হতাশ, তখন তেজপাতা চাষ তাদের দিয়েছে নতুন আশার আলো। বর্তমানে কাউনিয়ার তেজপাতা শুধু দেশের বাজারেই নয়, সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের ২১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
তেজপাতার বাগানে গ্রামের সাফল্যের গল্প
রাজীব গ্রামের কৃষক আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, ৬৬ শতক জমিতে ৩৩৩টি তেজপাতা গাছ লাগিয়ে তিনি মাত্র ৩০ হাজার টাকায় চাষ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত আয় করেছেন প্রায় ২ লাখ টাকা। একই গ্রামের আশরাফুল ইসলাম জানান, আগে যেখানে ধান ও পাট চাষ করতেন, এখন সেখানে তেজপাতার বাগান করেছেন। তার ভাষায়, “ধান চাষে পরিশ্রম বেশি, লাভ কম। কিন্তু তেজপাতায় খরচও কম, লাভও বেশি। একবার চারা রোপণ করলে প্রায় সারা জীবন ফলন পাওয়া যায়।”
তিনি আরও বলেন, প্রথম বছর মাত্র ৩ মণ পাতা বিক্রি করেছিলেন, বর্তমানে ১৬ মণ পর্যন্ত বিক্রি করছেন। পরের মৌসুমে আরও বেশি ফলনের আশা করছেন।
কম পরিশ্রমে বেশি লাভ
কৃষকদের মতে, তেজপাতা বাগান করতে জমিতে সামান্য চাষ ও সার প্রয়োগই যথেষ্ট। পাতা ছাগল বা গরু খায় না, ফলে ক্ষতির আশঙ্কাও নেই। একটি চারা রোপণের চার বছর পর থেকেই পাতা সংগ্রহ করা যায় এবং তা প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। বর্তমানে প্রতিটি গাছে বছরে ২৫ থেকে ৪০ কেজি পাতা পাওয়া যায়।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কেজিপ্রতি ১০৮–১১২ টাকায় কাঁচা পাতা কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় পুরো বাগানই চুক্তিতে বিক্রি করা হয়।
রপ্তানির চেইনে রংপুরের তেজপাতা
পীরগাছার চৈতারমোড় এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “কাউনিয়া থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০০ বস্তা তেজপাতা ঢাকায় পাঠানো হয়। এরপর রপ্তানিকারকরা তা সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ ২১টি দেশে পাঠান। কাউনিয়ার তেজপাতার মান ভালো, তাই চাহিদাও বেশি।”
বর্তমানে স্কয়ার, প্রাণ, পুষ্টি, তীর ও ইস্পাহানিসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় খাদ্য ও মসলা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাউনিয়া থেকে তেজপাতা সংগ্রহ করছে।
কৃষি কর্মকর্তাদের আশা ও পরামর্শ
টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজীব ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, ইউনিয়নের ৬০ হেক্টরের বেশি জমিতে এখন তেজপাতা চাষ হচ্ছে। কৃষিবিদ আবিদ করিম মুন্না বলেন, “গভীর বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি তেজপাতা চাষের জন্য আদর্শ। চারা লাগানোর ৪–৫ বছর পর থেকে শত বছর পর্যন্ত পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব।”
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া আকতার জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কয়েক শ বিঘা জমিতে তেজপাতার বাগান রয়েছে। কৃষকেরা বছরে কয়েক কোটি টাকার পাতা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, “তেজপাতা শুধু মসলা নয়, এটি ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ। ঔষধ তৈরিতেও এর ব্যবহার বাড়ছে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া তেজপাতা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।”
নতুন কৃষি বিপ্লবের ইঙ্গিত
কৃষি অধিদপ্তর জানিয়েছে, অনাবাদি জমি ফেলে না রেখে ধান, পাট ও সবজির পাশাপাশি কৃষকদের তেজপাতা চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, এটি এক প্রকার কৃষি বিপ্লবের সূচনা। কম খরচে বেশি লাভ—এই সমীকরণেই রংপুরের তেজপাতা এখন দেশের সীমা পেরিয়ে বিদেশি বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে।
সম্পাদনা: এম.রহমান/সবা
















