- চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত গেছেন ১৫৪৭৬ জন
- দেশভিত্তিক হিসাবে আগতদের ৩০ শতাংশই ছিলেন বাংলাদেশি
- ২০২৪ সালে একই সময়ে সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৩৪১ জন
- ২০২৩ সালে একই সময়ে এসেছিলে এক লাখ ৩৫ হাজার ৩১৯ জন
চলতি বছরের নয় মাসে সমুদ্রপথে ইটালিতে পাড়ি জমানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গেছে। তথ্যমতে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মোট ১৫ হাজার ৪৭৬ জন বাংলাদেশি সমুদ্রপথে ইটালির উপকূলে পৌঁছেছেন। দেশ অনুযায়ী হিসেব করে দেখা গেছে, চলতি বছর ইটালিতে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের এই সংখ্যা অন্য যেকোনো দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশভিত্তিক হিসাবে আগতদের ৩০ শতাংশই ছিলেন বাংলাদেশি।
এদিকে পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছর ইটালির উপকূলে আসা মোট অভিবাসীর সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক কমেছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের উল্লিখিত সময়ে মোট ৫১ হাজার ৮৫৫ জন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইটালিতে এসেছেন। ২০২৪ সালের একই সময়ে সংখ্যাটি ছিল ৫১ হাজার ৩৪১ জন। আর ২০২৩ সালে এই সময়ে এসেছিলেন এক লাখ ৩৫ হাজার ৩১৯ জন। সরকারের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসের তুলনায় ২০২৫ সালে বাংলাদেশিদের আগমন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালে এই সময়ে আট হাজার ৫২৬ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিতে এসেছিলেন। এ বছর তা বেড়ে ১৫ হাজার ৪৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যানে, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালিতে অভিবাসী আগমনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীদের আগমন ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশিদের পর সর্বাধিক সংখ্যক অভিবাসী এসেছে ইরিত্রিয়া ও মিশর থেকে। এই সংখ্যা যথাক্রমে সাত হাজার ৯০ জন ও ছয় হাজার ৫৫৮ জন। পাকিস্তান, সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও টিউনিশিয়া থেকেও কয়েক হাজার মানুষ এ সময় ইটালিতে পাড়ি জমিয়েছেন। অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান, সিরিয়া, গিনি, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, মালি ও আফগানিস্তান। আরও কিছু অভিবাসীর পরিচয় যাচাইয়ের কাজ এখনো চলমান। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টিই ছিল অভিবাসনের প্রধান মৌসুম। মে মাসে সাত হাজার ১৭৮ জন, জুনে সাত হাজার ৮৯ জন, জুলাইয়ে ছয় হাজার ৪৮৭ জন, আগস্টে ছয় হাজার ১৪৬ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ আট হাজার ৩১৫ জন অভিবাসী ইটালিতে পৌঁছান। অক্টোবরের প্রথম দিক পর্যন্ত আগমন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক একক অভিবাসীর সংখ্যাও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট নয় হাজার ১৫৬ জন শিশু ইটালিতে পৌঁছেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সামান্য বেশি হলেও ২০২৩ সালের উল্লিখিত সময়ের তুলনায় অনেক কম। ২০২৪ সালের এই সময়ে আট হাজার ৭৫২ শিশু এবং ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৮২০ শিশু ইটালিতে পৌঁছেছিল।
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপ আরও কঠোর হলেও বাংলাদেশিদের আগমনের ক্ষেত্রে তার প্রভাব তেমন পড়েনি।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম বলছে, এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের অন্তত ১০-১২টি জেলার লোকজন এভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া। এসব ক্ষেত্রে এখন ফেসবুকের নানা গ্রুপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারিতরা বা নির্যাতনের শিকার লোকজন দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচার মামলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে ১ হাজার ৩৪টি নতুন মামলা হয়েছে। আর পুরোনো মামলা ধরলে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা ঝুঁলে আছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন এবং এক হাজারের বেশি মামলার এখনো তদন্ত শেষ হয়নি।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলছেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা। এভাবে ইতালি যাওয়ার পথে অনেক প্রানহানি ঘটে। এ ছাড়াও লিবিয়ায় অনেক মানুষ ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার। ক্যাম্পে বন্দী রেখে তাদের নিযাতন করা হয়। এরপর পরিবারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। এই যে বিদেশে কাজ বা শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার, এটি ভয়াবহ সমস্যা। পাচারকারীরা এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সেই তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পিছিয়ে আবার পাচারের মামলাগুলোরও বিচার হচ্ছে না। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয়, তাদের সবাইকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখালেও তারা চাকরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। তবে এতকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না। ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টা করে। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পযর্ন্ত এই পথে অন্তত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, এ বছরের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় অন্তত ২৩ বাংলাদেশির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়, যারা লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে ভূমধ্যসাগরে সেটি ডুবে যায়।





















