০৮:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সিলেটে একঝাক পথকুকুরের গল্প

নিশির নির্মমতার বিপরীতে আছে সামিনের ভালোবাসাও

এক পাশে যেখানে আছে চরম নির্দয় আচরণ; ৮টি নিরীহ কুকুরছানা হত্যার মতো নির্মমতা। ঠিক তার উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে ১০ বছরের এক শিশুর সেই পথকুকুরের প্রতিই অপরিসীম মমতার বিশালতার চিত্র। বলছি সিলেটের গোয়াইটুলার সেই ছোট্ট কুকুরপ্রেমী সাইহান সামিনের কথা। এই বয়সেই সাইহান দেখিয়ে দিয়েছে, দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষই পারে পথপ্রাণীদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে। কুকুরময় সেই গল্প থাকছে এই ফিচারে ।

সিলেট শহরের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকার গোয়াইটুলায় সাইহানদের বাসা। সেখানে ঢুকতেই প্রথমেআপনার চোখে পড়বে গেইটের সতর্কতা; কুকুর হতে সাবধান। যত ভেতরে পা রাখবেন; ততই বিস্মিত হবেন। চোখের সামনে ভেসে উঠবে অনন্য এক কুকুরের জগত। একটি খুশিতে ল্যাজ নাড়ছে তো, অন্যটি ছুটে এসে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আবার কেউ চোখে মায়া নিয়ে তাকিয়ে। প্রতিটি কুকুরের আলাদা নাম, আলাদা আচরণ ও আলাদা গল্প আছে। টারজান, কাল্লু, চিংকু, লাল্লি, বল্টু— সবাই যেন সাইহান সামিনের পরিবারের সদস্য।

সাইহানের নিজ মুখের গল্প। বছর কয়েক আগে ছোট্ট সামিন বাড়ির সামনের রাস্তায় ৩টি বাচ্চা কুকুর দেখতে পায়। নাম দেয়— লালু, কালু ও ডন। প্রতিদিন খাবার দিয়ে, কোলে করে, সময় দিয়ে তাদের বড় করতে করতে একসময় সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কেউ অসুস্থ ছিল, কেউ ফেলে যাওয়া, কেউ গাড়ির ধাক্কা খেয়ে আহত— সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে সামিন। আজ সেই সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ছোট্ট সামিন বলেন— ‘ওরা কথা বলতে পারে না, তাই ওদের জন্য আমার মন কাঁদে। সবাই ওদের ভয় পায়, কেউ মারধরও করে। কিন্তু ওরা আমার কাছে পরিবার।’

 

কথা বলতে বলতে সামিনের চোখে এসব প্রাণীদের জন্য এক অদ্ভুত মমতার ঝিলিক দেখা গেলো। সাইহানের বাবা সাদিকুর রহমান সাকী। পেশায় সাংবাদিক। শুধু সিলেটই নয় দেশজুড়ে মিডিয়ায় তার সুখ্যাতি। যারা খোঁজ রাখেন তারা সাকীকে আলাদাভাবেই চেনেন— ভদ্র, বিনয়ী এবং আদর্শ মিডিয়া প্রতিনিধি হিসেবে। ছেলের এমন একটু আলাদা ধরনের উদ্যোগে তিনি বেশ গর্বিত। সাকী তার ছেলে নিয়ে বলেন— ‘ওর ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের প্রতি বেজায় মায়া। আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। এতাগুলো কুকুর ছোট সামিন সামলাবে কীভাবে? কিন্তু দেখলাম প্রতিদিন সময় দিয়ে, খাওয়ানো থেকে সেবা— সবই ও করার চেষ্টা করে । আমরা শুধু ওেকে সহযোগিতা করি ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকের সমাজে যেখানে আমরা মানুষের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা দেখি, সেখানে আমার ছেলরে প্রাণীদের প্রতি এই ভালোবাসা আমাদের জানিয়ে দেয় এখনো পৃথিবীতে মানবতা-মায়া মমতা ফুরয়ে যায়নি। কাকতালীয়ভাবে সাইহানের মা সূবর্ণা হামিদও পেশার সাংবাদিক। তাকেও এই পেশায় চিনতে অসুবিধে হয়না। স্বামী সাকীর সঙ্গে তার জুটিটাও আদর্শের বন্ধনে বেশ অটুট। সূবর্ণা প্রাণপ্রিয় আদুরে ছোলেকে নিয়ে বলেন— ‘শিশুরা সাধারণত খেলনা নিয়ে খেলে, কিন্তু আমাদের সামিন পশুপাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অনেকে বলে কুকুর রাখলে সমস্যা হয়। কিন্তু আমি দেখি—এই পশুগুলোই আমাদের বাড়িকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।’

একদিকে সভ্য সমাজ দেখছে পাবনায় চরম নিষ্ঠুরতা— যেখানে অমানবিকভাবে ৮টি কুকুরছানা হত্যা করা হয়। সেখানেই সামিন অন্যন্য। সেখানেই একজন মানবিক প্রাণীপ্রিয় সামিন দেশের জন্য বড় উদাহরণ। শিশুকণ্ঠে সামিনের দৃঢ় উচ্চারণ— ‘প্রতিটি প্রাণের তো দাম আছে, ওরা তো আমাদের মতোই ব্যথা পায়। এভাবে কেনো ওদের হত্যা করা হলো। সমাজের যেনো এমন ঘটনা আমাদের না দেখতে হয়।’

সামিনের বাড়ি কেবল কুকুরের আশ্রয়স্থল নয়, মানবিকতারও আশ্রয়স্থল। তার এই কাজ সমাজকে বদলাতে শেখায়। মনে রাখতে দয়া কখনো ছোট হয় না, আর হৃদয়ের বড়ত্ব বয়স দিয়ে মাপা যায় না। হয়তো সামিন নিজে কঠিনভাবে না বুছলেও সেই চির মর্মবাণী অনুধাবণ করেছেন— ‘জীবে প্রেম করে যেজন; সেজন সেবিছে ঈশ্বর।’ তা করতে পারছেন বলেই প্রাণীপ্রেমী সামিন জেলা পর্যায়ে প্রাণীসম্পদ মেলায় ‘সেরা প্রদর্শক’ হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রাণীদের মিলনমেলায় সামিনের সরব উপস্থিতি সবাইকে আরো বেশি মুগ্ধ করে।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

সিলেটে একঝাক পথকুকুরের গল্প

নিশির নির্মমতার বিপরীতে আছে সামিনের ভালোবাসাও

আপডেট সময় : ০৮:৩২:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫

এক পাশে যেখানে আছে চরম নির্দয় আচরণ; ৮টি নিরীহ কুকুরছানা হত্যার মতো নির্মমতা। ঠিক তার উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে ১০ বছরের এক শিশুর সেই পথকুকুরের প্রতিই অপরিসীম মমতার বিশালতার চিত্র। বলছি সিলেটের গোয়াইটুলার সেই ছোট্ট কুকুরপ্রেমী সাইহান সামিনের কথা। এই বয়সেই সাইহান দেখিয়ে দিয়েছে, দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষই পারে পথপ্রাণীদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে। কুকুরময় সেই গল্প থাকছে এই ফিচারে ।

সিলেট শহরের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকার গোয়াইটুলায় সাইহানদের বাসা। সেখানে ঢুকতেই প্রথমেআপনার চোখে পড়বে গেইটের সতর্কতা; কুকুর হতে সাবধান। যত ভেতরে পা রাখবেন; ততই বিস্মিত হবেন। চোখের সামনে ভেসে উঠবে অনন্য এক কুকুরের জগত। একটি খুশিতে ল্যাজ নাড়ছে তো, অন্যটি ছুটে এসে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আবার কেউ চোখে মায়া নিয়ে তাকিয়ে। প্রতিটি কুকুরের আলাদা নাম, আলাদা আচরণ ও আলাদা গল্প আছে। টারজান, কাল্লু, চিংকু, লাল্লি, বল্টু— সবাই যেন সাইহান সামিনের পরিবারের সদস্য।

সাইহানের নিজ মুখের গল্প। বছর কয়েক আগে ছোট্ট সামিন বাড়ির সামনের রাস্তায় ৩টি বাচ্চা কুকুর দেখতে পায়। নাম দেয়— লালু, কালু ও ডন। প্রতিদিন খাবার দিয়ে, কোলে করে, সময় দিয়ে তাদের বড় করতে করতে একসময় সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কেউ অসুস্থ ছিল, কেউ ফেলে যাওয়া, কেউ গাড়ির ধাক্কা খেয়ে আহত— সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে সামিন। আজ সেই সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ছোট্ট সামিন বলেন— ‘ওরা কথা বলতে পারে না, তাই ওদের জন্য আমার মন কাঁদে। সবাই ওদের ভয় পায়, কেউ মারধরও করে। কিন্তু ওরা আমার কাছে পরিবার।’

 

কথা বলতে বলতে সামিনের চোখে এসব প্রাণীদের জন্য এক অদ্ভুত মমতার ঝিলিক দেখা গেলো। সাইহানের বাবা সাদিকুর রহমান সাকী। পেশায় সাংবাদিক। শুধু সিলেটই নয় দেশজুড়ে মিডিয়ায় তার সুখ্যাতি। যারা খোঁজ রাখেন তারা সাকীকে আলাদাভাবেই চেনেন— ভদ্র, বিনয়ী এবং আদর্শ মিডিয়া প্রতিনিধি হিসেবে। ছেলের এমন একটু আলাদা ধরনের উদ্যোগে তিনি বেশ গর্বিত। সাকী তার ছেলে নিয়ে বলেন— ‘ওর ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের প্রতি বেজায় মায়া। আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। এতাগুলো কুকুর ছোট সামিন সামলাবে কীভাবে? কিন্তু দেখলাম প্রতিদিন সময় দিয়ে, খাওয়ানো থেকে সেবা— সবই ও করার চেষ্টা করে । আমরা শুধু ওেকে সহযোগিতা করি ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকের সমাজে যেখানে আমরা মানুষের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা দেখি, সেখানে আমার ছেলরে প্রাণীদের প্রতি এই ভালোবাসা আমাদের জানিয়ে দেয় এখনো পৃথিবীতে মানবতা-মায়া মমতা ফুরয়ে যায়নি। কাকতালীয়ভাবে সাইহানের মা সূবর্ণা হামিদও পেশার সাংবাদিক। তাকেও এই পেশায় চিনতে অসুবিধে হয়না। স্বামী সাকীর সঙ্গে তার জুটিটাও আদর্শের বন্ধনে বেশ অটুট। সূবর্ণা প্রাণপ্রিয় আদুরে ছোলেকে নিয়ে বলেন— ‘শিশুরা সাধারণত খেলনা নিয়ে খেলে, কিন্তু আমাদের সামিন পশুপাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অনেকে বলে কুকুর রাখলে সমস্যা হয়। কিন্তু আমি দেখি—এই পশুগুলোই আমাদের বাড়িকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।’

একদিকে সভ্য সমাজ দেখছে পাবনায় চরম নিষ্ঠুরতা— যেখানে অমানবিকভাবে ৮টি কুকুরছানা হত্যা করা হয়। সেখানেই সামিন অন্যন্য। সেখানেই একজন মানবিক প্রাণীপ্রিয় সামিন দেশের জন্য বড় উদাহরণ। শিশুকণ্ঠে সামিনের দৃঢ় উচ্চারণ— ‘প্রতিটি প্রাণের তো দাম আছে, ওরা তো আমাদের মতোই ব্যথা পায়। এভাবে কেনো ওদের হত্যা করা হলো। সমাজের যেনো এমন ঘটনা আমাদের না দেখতে হয়।’

সামিনের বাড়ি কেবল কুকুরের আশ্রয়স্থল নয়, মানবিকতারও আশ্রয়স্থল। তার এই কাজ সমাজকে বদলাতে শেখায়। মনে রাখতে দয়া কখনো ছোট হয় না, আর হৃদয়ের বড়ত্ব বয়স দিয়ে মাপা যায় না। হয়তো সামিন নিজে কঠিনভাবে না বুছলেও সেই চির মর্মবাণী অনুধাবণ করেছেন— ‘জীবে প্রেম করে যেজন; সেজন সেবিছে ঈশ্বর।’ তা করতে পারছেন বলেই প্রাণীপ্রেমী সামিন জেলা পর্যায়ে প্রাণীসম্পদ মেলায় ‘সেরা প্রদর্শক’ হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রাণীদের মিলনমেলায় সামিনের সরব উপস্থিতি সবাইকে আরো বেশি মুগ্ধ করে।

এমআর/সবা