মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠুকে নিয়ে দলের ভেতরেই নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচিত হওয়ার আগেই তিনি এলাকায় একপ্রকার ‘অঘোষিত এমপি’ হয়ে উঠেছেন। গত ১৭ বছর হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার সিনিয়র ও তরুণ নেতাদের অবমূল্যায়ন করছেন। এমনকি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিভেদ নিরসন ও ঐক্য জোরদারের নির্দেশনা উপেক্ষারও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এদিকে হাকালুকি হাওরে মাছ লুটকাণ্ডে তার নাম উঠে এসেছে।
বিএনপির প্রবীণ নেতারা বলছেন, নাসির উদ্দিন মিঠু বিএনপিকে ধারণ করেন না। মূলত শিবিরের রাজনীতি দিয়ে তার ছাত্রজীবন শুরু। তাই তাকে মেনে নিতে পারছেন না দলীয় নেতাকর্মীরা। সভা-সমাবেশসহ বিভিন্নভাবে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
প্রবীণ নেতারা আরও জানান, মিঠু ১৯৮৬ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবিরের প্যানেল থেকে ‘ইফতেষার-মিঠু পরিষদ’ নামে নির্বাচন করেন। ছাত্রলীগের কাছে হেরে যান। তারপর ঢাকায় চলে যান। তিনি বিএনপির আদর্শের প্রকৃত সৈনিক নন। ২০১২ সালে এলাকায় ফিরে বিএনপিতে যোগদান করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে এই আসনে নির্বাচন করেন। সে সময়ও বিএনপির বড় একটি অংশ তার সঙ্গে ছিল না। অনেকে তাকে ‘সাইলেন্ট জামায়াত’ বলে অভিযোগ করছেন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বড়লেখা ও জুড়ীতে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে মিঠুর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে হাকালুকি হাওরে সবচেয়ে বড় জলমহাল ‘হাওরখাল’ বিল থেকে মাছ লুটপাটের নেপথ্যে মূল বিনিয়োগকারী ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে তার নাম উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, তার নির্দেশেই বিরাট অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি ও মাছ লুটের ঘটনা সংঘটিত হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মাছ বিক্রির সময় একাধিকবার মিঠুর ম্যানেজার নাজমুলকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। মুখ বাঁধা অবস্থায় তাকে মাছ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার তদারকি করতে দেখা যায়। এছাড়াও মিঠুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত বড়লেখার বর্ণী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সদ্য সাবেক আহবায়ক জয়নাল আবেদীন এবং সিনিয়র সহসভাপতি নছিব আলীর নামও এ ঘটনায় জড়িয়েছে।
স্থানীয় নেতাদের মতে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্থানীয় বিএনপির দীর্ঘদিনের বিভেদ নিরসন ও দলীয় ঐক্য সুসংহত করার নির্দেশ বাস্তবায়নেও ব্যর্থ হয়েছেন মিঠু। মনোনয়ন পাওয়ার প্রায় দেড় মাস পার হলেও মিঠু এ নিয়ে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। বরং মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার বলয়ের কয়েকজন নেতার স্বাক্ষরিত দলীয় প্যাডে লিখিত একটি অভিযোগ কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের মতে, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা বিএনপি বর্তমানে তিন ধারায় বিভক্ত। একাংশ নাসির উদ্দিন মিঠুর সঙ্গে, আরেক অংশ শরিফুল হক সাজুর পক্ষে এবং তৃতীয় অংশ সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে জহরত আদিব চৌধুরীর সঙ্গে। তবে, মিঠুকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ার পর এবাদুর বলয়ের নেতাকর্মীরা শরীফুল হক সাজুর সঙ্গে বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচি ও ধানের শীষের পক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করছেন। সেই হিসাবে বলা যায়, সাজুর পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীরা বেশ ঐক্যবদ্ধ।
এসব বিষয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য মুজিব রাজা চৌধুরী বলেন, তিনি তো দলের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছেন না। তিনি ও তার ছায়াসঙ্গী কয়েকজন নেতাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যার ফলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। হাওরের মাছকাণ্ড নিয়েও প্রভাব পড়ছে। মানুষ মনে করছে যাদের নাম মিডিয়াতে এসেছে, তারা বিবৃতি দেবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এ নিয়ে মিঠু ভাই কোনো বিবৃতি দেননি, তিনি যে হাওরে মাছকাণ্ডে জড়িত নন এটা সাধারণ মানুষ জানবে কিভাবে।
পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুতাব আলী বলেন, মিঠু সাহেব মনোনয়ন পাওয়ার পর সাবেক এবাদুর রহমান চৌধুরীর অনুসারীরা মনে করেছিলেন তিনি দলের দীর্ঘদিনের বিভেদ নিরসনে উদ্যাগী হবেন, সবাইকে ডাকবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। মৌলভীবাজার-১ আসনে মনে হচ্ছে জামায়াতের পাল্লা ভারী হবে। কারণ মানুষ (ধানের শীষের) প্রার্থী পাচ্ছে না তার নিষ্ক্রিয়তার কারণে।
বড়লেখা পৌর বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন, তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই মিঠু ও তার পক্ষের লোকজন এমপি এমপি ভাব ধরেছেন। আমরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নই। কিন্তু তাকে নিয়ে এই নির্বাচনি বৈতরণী জামায়াতের সঙ্গে পার হওয়া খুবই কঠিন। আমার মনে হয় প্রার্থীর ব্যাপারে দল পুনর্বিবেচনা করুক। দল মাঠে জরিপ চালাক। যে প্রার্থী ধানের শীষকে বিজয়ী করতে পারবে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। তিনি আরও বলেন, মিঠু বিগত ১৭ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে চলেছেন। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটি জিডি নেই।
বড়লেখা পৌর বিএনপির সদস্য আব্দুল হাফিজ চৌধুরী আবু বলেন, প্রার্থী ঘোষণার পর বিএনপিতে কোনো ঐক্য নেই। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না।
জুড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান আসকর বলেন, ২০১২ সালের দিকে আমরা যুবদল করতাম। আমি ও শিপলুর হাত ধরেই তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বিএনপির কাউন্সিলে যুগ্ম আহ্বায়ক থেকে আমাকে মাইনাস করেছেন। দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর তৃণমূলের কোনো নেতাকর্মীর তার কাছে যেতে পারছে না। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিএনপির আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে দীর্ঘদিন পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে সক্রিয় হন এবং মনোনয়ন নিয়ে আসেন।
বড়লেখা উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান ফারুক বলেন, দল যাকে প্রার্থী করেছে তাকে আমরা মেনে নিতে পারছি না। সভা-সমাবেশ করে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি করে আসছি। নিশ্চয়ই দল মাঠ জরিপ করে পুনর্বিবেচনা করবে। মিঠুকে মেনে না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে তো বিএনপিকে ধারণ করে না। শিবিরের রাজনীতি করে আসা কোনো মানুষ তার আদর্শ বদলাতে পারে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন মিঠু বলেন, দলে কোনো বিভেদ নেই। সবাই তার সঙ্গে আছেন। যারা নানা কথা বলছেন তারা মূলত মনোনয়ন বঞ্চিতদের হয়ে কথা বলছেন। শিবিরের রাজনীতি করার কথা অস্বীকার করেন তিনি। এছাড়া হাকালুকি হাওরে মাছ লুটের বিষয়ে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও জানান তিনি।





















