- রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতার তাগিদ
- ৮ ভাগের এক ভাগ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত
তফসিল ঘোষণার সাথে হুইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে নির্বাচনি ট্রেন। ভোটের তারিখ, সময় ও মনোনয়নসহ ভোট-সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি জেনে গেছে জাতি। শেষ তিনটি নির্বাচনে যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি দেখা গেছে, যে দুর্নাম কুড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি), ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ এসেছে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর এখন বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধি মানছে কি না, তা তদারকি করা। এ ছাড়া রয়েছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার পাহাড়সম বাধা। নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, একটা নির্বাচন কমিশন একা একা নির্বাচন করতে পারে না; তারা যত শক্তিশালী হোক, পারবে না। যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগিতা না করে। নির্বাচন কমিশনকে মনিটরিং করতে হবে, আচরণবিধি ভাঙলে বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। নাহলে মাঠ সমান থাকবে না, পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, আমরা জানি আমাদের পুলিশ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে এখনও সেনাবাহিনী দেশে আছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার সে রকম উন্নতি আমরা দেখি না। এ ধরনের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার যদি অ্যাপ্লাই করা হয়, তাহলে সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা আরও মুশকিল হবে। এবারের নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পটভ‚মি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে যাচ্ছে মনে করেন অনেকে। কেননা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট এবারের নির্বাচনের নতুন অনুসঙ্গ। এর সাথে পরিচিত নন সাধারণ ভোটররা। তাই বিভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন দিলারা চৌধুরী। তিনি বলনে, নির্বাচনে দুটি ব্যালট এবং দুটি বুথ করার কথা বলা হয়েছিল। এখানে ভোটাররা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণভোট কিন্তু সাধারণত হয়, গণভোটের ব্যাপক প্রচার থাকতে হয় এবং একটিই প্রশ্ন থাকে যে—আপনার এটিতে সম্মত কি না? সুযোগ আছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার। না হলে পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে ভোটিং ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করে ক্ষমতাদখলের।
এদিকে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হবে আগামী ১২ ফেব্রæয়ারি। একই দিন হবে গণভোটও। ওইদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। এদিকে, গতকাল শনিবার পরিপত্র-২ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি সচিবালয়ের উপ-সচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২ অধিশাখা) মোহাম্মদ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত এ পরিপত্রে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল ও গ্রহণ, জামানত, প্রস্তাবকারী-সমর্থনকারীর যোগ্যতা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন, মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের তথ্য প্রদান, মনোনয়নপত্র বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার, বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। ইসির জারিকৃত পরিপত্রে দেখা গেছে, কোনো প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট পেতে হবে। অন্যথায় জামানত বাবদ জমা দেওয়া ৫০ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থীকে ৫০ হাজার টাকা জামানত জমা দিতে হবে। এ অর্থ নগদ, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার বা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ইসির অনুক‚লে জমা দেওয়া যাবে। একই নির্বাচনি এলাকায় একাধিক মনোনয়নপত্র দিলে একটি জামানতই যথেষ্ট হবে। অন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে চালানের সত্যায়িত অনুলিপি দিতে হবে। জামানতের বাইরে কোনো অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ বা প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জামানতের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক, যেকোনো ব্যাংক বা সরকারি ট্রেজারি বা সাব ট্রেজারিতে ১০৯০৩০২১০১৪৪৩-৮১১৩৫০১ কোড নম্বরে জমা দিতে হবে। নগদে প্রাপ্ত জামানতের অর্থ রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার সরকারি খাতে জমা দিবেন। পরিপত্রে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সম্ভাব্য প্রার্থীরা রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে সরাসরি দাখিলের জন্য মনোনয়ন ফরম (ফরম-১) সংগ্রহ করবেন। ইতিমধ্যে এসব ফরম ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই ফরম বিতরণের জন্য আলাদা রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যোগ্য ব্যক্তিরা যথাযথভাবে পূরণ করা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল বা জমা দেওয়া যাবে। ইসির নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী, আগামী ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন। ওই দিন বা তার আগের যেকোনো দিনে প্রার্থী, প্রস্তাবকারী বা সমর্থনকারী মনোনয়নপত্র দাখিল করলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুচ্ছেদ ১২ এর (৩) অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার তা গ্রহণ করবেন। অফিসারগণ মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার সময় নির্ধারিত স্থানে ক্রমিক নম্বর দেবেন। রিটার্নিং অফিসার মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার সময় ‘রিঅ-’ এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার ‘সরিঅ-’ লিখে নম্বর দেবেন। এক প্রার্থী একাধিক মনোনয়নপত্র জমা দিলে প্রথমটিতে পূর্ণ নম্বর এবং অন্যগুলোর ক্ষেত্রে বন্ধনীতে (ক), (খ) বা (১), (২) ব্যবহার করা যাবে। মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার সময় প্রতিটি মনোনয়নপত্রের তথ্য রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে মনোনয়নপত্রের তৃতীয় অংশে দাখিলকারীর নাম, জমাদানের তারিখ ও সময় উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া, নির্বাচনি এলাকার নাম ও নম্বর, প্রার্থীর নাম, মনোনয়নপত্র জমার তারিখ ও সময় এবং বাছাইয়ের নির্ধারিত তারিখ, সময় ও স্থান উল্লেখ করে মনোনয়নপত্রের পঞ্চম অংশে যুক্ত থাকা প্রাপ্তিস্বীকার রসিদ তাৎক্ষণিকভাবে প্রার্থী বা প্রস্তাবকারী বা সমর্থনকারীকে দিতে হবে। ইসির জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারের ওপর ন্যস্ত। তাই সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিলকৃত সব মনোনয়নপত্র ২৯ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার পরপরই নিরাপত্তার সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার যে কোনো ভোটার সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রস্তাব বা সমর্থন করতে পারবেন। তবে প্রস্তাবকারী বা সমর্থনকারী হিসেবে কেউ একাধিক মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করতে পারবেন না। প্রতিটি মনোনয়নপত্রে প্রার্থীর সম্মতি, অযোগ্যতা না থাকার ঘোষণা এবং তিনটির বেশি নির্বাচনি এলাকায় মনোনয়ন জমা না দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দলের নিজস্ব প্যাডে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারীর স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে। একটি নির্বাচনি এলাকায় যদি কোনো রাজনৈতিক দল একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, তবে আগামী ২০ জানুয়ারি বিকেল ৫টার মধ্যে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম লিখিতভাবে রিটার্নিং অফিসারকে জানাতে হবে। চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থী দলীয় প্রতীক পাবেন, যদি না তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। প্রতীক বরাদ্দ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পরে আলাদা পরিপত্রে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন ইসি। নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, একটা নির্বাচন না। আগামী ২০-৩০ বছরের নির্বাচনের জন্য আমাদের এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে নির্বাচনি পদ্ধতিকে ব্যবহার করে কেউ কোনোদিন ক্ষমতায় না আসতে পারে। অর্থাৎ এখানে নির্বাচনকে ধারাবাহিকভাবে সুষ্ঠু করতে হবে। এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি ভোটার, যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ। জুলাই অভ্যুত্থানের জেরে বিপর্যস্ত পুলিশ বাহিনীকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে এ নিয়ে পর্যবেক্ষক মহল বা জনমনে স্বস্তি এখনো ফেরেনি। এমন অবস্থায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সম্ভাব্য নেতিবাচক তৎপরতা, জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর মতবিরোধ, লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার না হওয়া—এ সব মিলিয়ে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে উত্তেজনা ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ওপরের চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অন্যথায় তা অবনতির দিকে যেতে পারে। আগামী ১২ ফেব্রæয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত গণভোটও নেওয়া হবে। গত বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ভোটের তফসিল ঘোষণা করার পর তরুণদের দল এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী একে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এ সময় অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীর উদাসীনতা রয়েছে এবং অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। এর ২৪ ঘণ্টা না যেতেই গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীতে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়েছেন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের আহŸায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদী। মাথায় গুলি লাগার পর বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে রয়েছেন এই জুলাই যোদ্ধা।























