০২:৩৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৬, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৭টি আসনের মধ্যে মাত্র ১টিতে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আ’লীগ ঐক্যবদ্ধ

বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে বগুড়ায় দুচিন্তায় আওয়ামীলীগ ও মহাজোট প্রার্থীরা

স্বাধীনতার পর এবারের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন একটু ভিন্ন স্বাদের। এবারের নিবাচন দেশের বৃহত্তর দল বিএনপি বিহীন। এই বিএনপি বিহীন নির্বাচনেও
স্বতন্ত্র প্রাথীদের জনপ্রিয়তায় বগুড়ায় আওয়ামীলীগ ও মহাজোটের প্রাথীরা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় জেলার সবগুলো আসনেই এবার ওই দলটির চির প্রতিদ্বদ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ৭টি আসনের মধ্যে তিনটি আসন (বগুড়া-২,বগুড়া-৩ এবং বগুড়া-৪) ১৪ দলীয় জোটের শরীক জাসদ ও মিত্র দল জাতীয় পার্টির জন্য ছেড়ে দেওয়ায় সেই সম্ভাবনা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। ওই আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজ দলের অথবা বিএনপি ছেড়ে আসা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন।

আর জেলার অন্য ৪টি আসনে দলীয় যে প্রার্থী রাখা হয়েছে তার মাত্র একটিতে (বগুড়া-৫) কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন। কিন্তু অপর ৩টি আসনের দু’টিতেই (বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৬) আওয়ামী লীগের বর্তমান এবং সাবেক একাধিক প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকাকে রীতিমত ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। বাকি একটি আসনে (বগুড়া-৭) নৌকার সমর্থকরা ভেতরে ভেতরে বিএনপি ছেড়ে আসা এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন এবং ক্রমশ তারা দলভারি করছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, জাসদ এবং জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি নিজ দলের নেতাদেরকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় উৎসাহ দেওয়ার কারণেস্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের দাপটের মুখে দলীয় অনেক প্রার্থী বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিজেদের প্রচারণায় পাশে চেয়েও পাচ্ছেন না। এতে অনেক ক্ষেত্রেই নৌকার প্রার্থীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে বগুড়া-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এক আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থকরা তো নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুকে প্রকাশ্যেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, এভাবে চলতে থাকলে স্বতন্ত্র প্রার্থীমুক্ত বগুড়া-৫  (শেরপুর ও ধুনট উপজেলা) আসন ছাড়া বাকি ৩টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের জয়লাভ রীতিমত কঠিন হয়ে পড়বে। একইভাবে আসন ছাড় দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা) আসনে জাসদ নেতাকে দেওয়া নৌকা এবং বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) ও বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া উপজেলা) আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হতে পারে।

নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার সবগুলো আসনই আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। কিন্তু বগুড়ায় জন্ম নেওয়া তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার এক বছর পর দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সবগুলো আসনই নবগঠিত দলটির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষের দখলে চলে যায়। মাঝে ১৯৮৬ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেলার একটি আসনে (বগুড়া-৫) বিজয়ী হয়। তবে ২০০৮ সালে জেলার ৭টি আসনের মধ্যে তিনটি (বগুড়া-২, বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৭) যথাক্রমে জাসদ এবং জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ছেড়ে দেওয়া ওই আসনগুলোতে জোট প্রার্থীরা বিজয়ী না হলেও অন্য দু’টি আসনে (বগুড়া-১ এবং বগুড়-৫) নৌকা প্রার্থীরা যথারীতি বিজয়ী হন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৫ আসন আওয়ামী লীগ নিজেদের কাছে রেখে অন্য ৫টি জাসদ এবং জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। তবে ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকায় নিজেদের দু’টি আসনের (বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৫) পাশাপাশি ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে জাসদ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা সহজেই বিজয়ী হন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ আগের দু’টি আসনে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও দু’টি আসনে বিজয়ী হন। বাকি তিনটির মধ্যে দু’টিতে বিএনপি এবং অপর একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রথমে বগুড়ার ৭টি আসনেই আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দেয়। পরবর্তীতে আসন ভাগা-ভাগির দাবি উঠলে ১৪ দলীয় জোট সঙ্গী জাসদকে বগুড়া-৪ এবং মিত্র দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে বগুড়া-২ এবং বগুড়া-৩ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড় দেওয়া ওই ৩টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থী ‘লাঙ্গল’ নিয়ে ভোট করলেও জাসদের প্রার্থী ‘নৌকা’ নিয়ে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করছেন।

তবে আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগের তৃণমুলের নেতা-কর্মীরা ভালোভাবে নেননি। যে কারণে তারা ওই তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বগুড়া-২ আসনে মিত্র দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ্’র বিপক্ষে গিয়ে সাবেক বিএনপি নেত্রী বিউটি বেগমের ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এরই মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক আতিক রহমান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘ট্রাক’ প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সভা করে ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে কাজ করার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
একই অবস্থা বগুড়া-৩ আসনেও। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেখানেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী নূরুল ইসলাম তালুকদারের ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ‘লাঙ্গল’কে ঠেকাতে তারা আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের যে তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন। তবে এর মধ্যেআদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অজয় কুমার সরকারের ‘কাঁচি’ প্রতীকের প্রতি নেতা-কর্মীদের সমর্থন বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব এবং ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক খাঁন মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মেহেদীর ‘ট্রাক’ এবং বঙ্গবন্ধু প্রজন্মলীগ নেতা ফেরদৌস স্বাধীন ফিরোজের ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষেও শাসক দলের নেতা-কর্মীদের সমর্থন বাড়ছে। অন্যদিকে বগুড়া-৪ আসনে জাসদ নেতার নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোন নেতা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ না হওয়ায় সেখানে ক্ষমতাসীন ওই দলের নেতা-কর্মীরা বিকল্প হিসেবে সাবেক বিএনপি নেতা ডা. জিয়াউল হক মোল্লার ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষে ঝুঁকেছেন।

অন্য ৪টি আসনের মধ্যে বগুড়া-১ আসনে দলের দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাহাদারা মান্নানের নৌকা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর মধ্যে ‘ঈগল’ প্রতীকধারী কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান শ্যামল আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কটির সদস্য এবং ‘তবলা’ প্রতীকধারী শাহজাদী আলম লিপি অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকায় সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ওই দুই প্রার্থীর পাশাপাশি সাবেক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ শোকরানা লড়ছেন ‘কেটলি’ প্রতীক নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›দ্বী তিনজনই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। যে কারণে তারা প্রচার-প্রচারণায় নৌকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বগুড়া-৬ আসনেও নৌকার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছেন দলটির সাবেক নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে তারা আরও একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ক’দিন আগে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দের অনুসারীরা তার ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশ থেকে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু এবং তার প্রতীক নৌকার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। ওই সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বগুড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম নৌকা প্রতীকধারী রাগেবুল আহসান রিপুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন এবং কেউ ভোট চুরি করতে আসে তার হাত গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন। আমিনুল ইসলামের ওই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এরই মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। আরেক সাবেক যুবলীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর আব্দুল মতিন সরকার গত উপ নিবাচনে রিপু এমপির পক্ষে কাজ করলেও এবার করছেন আব্দুল মান্নান আকন্দের পক্ষে।

বগুড়া-৭ আসনে আওয়ামী লীগের কেউ দলের মনোনীত প্রার্থী ডা. মোস্তফা আলম নাননুর নৌকার বিপক্ষে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ না হলেও দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত একাধিক নেতা এবং তাদের সমর্থকরা সাবেক বিএনপি নেতা সরকার বাদলের ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। একাধিক সূত্র জানায়, শাজাহানপুর উপজেলার আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের একাধিক নেতা সম্প্রতি গোপনে সরকার বাদলের সঙ্গে বৈঠক করে তাকে বিজয়ী করতে সম্ভাব্য সব কিছু করার প্রতশ্রুতি দিয়েছেন।
বগুড়া-৭ টি আসন ভাগা-ভাগি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট অসন্তোষ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া-৬ আসনের প্রার্থী রাগেবুল আহসান রিপু সাংবাদিকদের বলেছেন,  দলীয় প্রধানের দেওয়া নিদেশনা নেতা-কর্মীরা পালন করে আসছে। দলীয় প্রাথী ও মহাজোট প্রাথীর পক্ষে কাজ করছে নেতাকর্মীরা। বগুড়ার সকল আসনে নৌকা ও মহাজোটের প্রাথীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।

৭টি আসনের মধ্যে মাত্র ১টিতে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আ’লীগ ঐক্যবদ্ধ

আপডেট সময় : ০৫:৩১:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৪

বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে বগুড়ায় দুচিন্তায় আওয়ামীলীগ ও মহাজোট প্রার্থীরা

স্বাধীনতার পর এবারের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন একটু ভিন্ন স্বাদের। এবারের নিবাচন দেশের বৃহত্তর দল বিএনপি বিহীন। এই বিএনপি বিহীন নির্বাচনেও
স্বতন্ত্র প্রাথীদের জনপ্রিয়তায় বগুড়ায় আওয়ামীলীগ ও মহাজোটের প্রাথীরা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় জেলার সবগুলো আসনেই এবার ওই দলটির চির প্রতিদ্বদ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ৭টি আসনের মধ্যে তিনটি আসন (বগুড়া-২,বগুড়া-৩ এবং বগুড়া-৪) ১৪ দলীয় জোটের শরীক জাসদ ও মিত্র দল জাতীয় পার্টির জন্য ছেড়ে দেওয়ায় সেই সম্ভাবনা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। ওই আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজ দলের অথবা বিএনপি ছেড়ে আসা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন।

আর জেলার অন্য ৪টি আসনে দলীয় যে প্রার্থী রাখা হয়েছে তার মাত্র একটিতে (বগুড়া-৫) কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন। কিন্তু অপর ৩টি আসনের দু’টিতেই (বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৬) আওয়ামী লীগের বর্তমান এবং সাবেক একাধিক প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকাকে রীতিমত ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। বাকি একটি আসনে (বগুড়া-৭) নৌকার সমর্থকরা ভেতরে ভেতরে বিএনপি ছেড়ে আসা এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন এবং ক্রমশ তারা দলভারি করছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, জাসদ এবং জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি নিজ দলের নেতাদেরকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় উৎসাহ দেওয়ার কারণেস্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের দাপটের মুখে দলীয় অনেক প্রার্থী বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিজেদের প্রচারণায় পাশে চেয়েও পাচ্ছেন না। এতে অনেক ক্ষেত্রেই নৌকার প্রার্থীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে বগুড়া-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এক আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থকরা তো নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুকে প্রকাশ্যেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, এভাবে চলতে থাকলে স্বতন্ত্র প্রার্থীমুক্ত বগুড়া-৫  (শেরপুর ও ধুনট উপজেলা) আসন ছাড়া বাকি ৩টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের জয়লাভ রীতিমত কঠিন হয়ে পড়বে। একইভাবে আসন ছাড় দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা) আসনে জাসদ নেতাকে দেওয়া নৌকা এবং বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) ও বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া উপজেলা) আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হতে পারে।

নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার সবগুলো আসনই আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। কিন্তু বগুড়ায় জন্ম নেওয়া তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার এক বছর পর দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সবগুলো আসনই নবগঠিত দলটির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষের দখলে চলে যায়। মাঝে ১৯৮৬ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেলার একটি আসনে (বগুড়া-৫) বিজয়ী হয়। তবে ২০০৮ সালে জেলার ৭টি আসনের মধ্যে তিনটি (বগুড়া-২, বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৭) যথাক্রমে জাসদ এবং জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ছেড়ে দেওয়া ওই আসনগুলোতে জোট প্রার্থীরা বিজয়ী না হলেও অন্য দু’টি আসনে (বগুড়া-১ এবং বগুড়-৫) নৌকা প্রার্থীরা যথারীতি বিজয়ী হন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৫ আসন আওয়ামী লীগ নিজেদের কাছে রেখে অন্য ৫টি জাসদ এবং জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। তবে ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকায় নিজেদের দু’টি আসনের (বগুড়া-১ এবং বগুড়া-৫) পাশাপাশি ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে জাসদ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা সহজেই বিজয়ী হন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ আগের দু’টি আসনে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও দু’টি আসনে বিজয়ী হন। বাকি তিনটির মধ্যে দু’টিতে বিএনপি এবং অপর একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রথমে বগুড়ার ৭টি আসনেই আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দেয়। পরবর্তীতে আসন ভাগা-ভাগির দাবি উঠলে ১৪ দলীয় জোট সঙ্গী জাসদকে বগুড়া-৪ এবং মিত্র দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে বগুড়া-২ এবং বগুড়া-৩ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড় দেওয়া ওই ৩টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থী ‘লাঙ্গল’ নিয়ে ভোট করলেও জাসদের প্রার্থী ‘নৌকা’ নিয়ে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করছেন।

তবে আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগের তৃণমুলের নেতা-কর্মীরা ভালোভাবে নেননি। যে কারণে তারা ওই তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বগুড়া-২ আসনে মিত্র দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ্’র বিপক্ষে গিয়ে সাবেক বিএনপি নেত্রী বিউটি বেগমের ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এরই মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক আতিক রহমান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘ট্রাক’ প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সভা করে ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে কাজ করার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
একই অবস্থা বগুড়া-৩ আসনেও। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেখানেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী নূরুল ইসলাম তালুকদারের ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ‘লাঙ্গল’কে ঠেকাতে তারা আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের যে তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন। তবে এর মধ্যেআদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অজয় কুমার সরকারের ‘কাঁচি’ প্রতীকের প্রতি নেতা-কর্মীদের সমর্থন বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব এবং ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক খাঁন মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মেহেদীর ‘ট্রাক’ এবং বঙ্গবন্ধু প্রজন্মলীগ নেতা ফেরদৌস স্বাধীন ফিরোজের ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষেও শাসক দলের নেতা-কর্মীদের সমর্থন বাড়ছে। অন্যদিকে বগুড়া-৪ আসনে জাসদ নেতার নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোন নেতা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ না হওয়ায় সেখানে ক্ষমতাসীন ওই দলের নেতা-কর্মীরা বিকল্প হিসেবে সাবেক বিএনপি নেতা ডা. জিয়াউল হক মোল্লার ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষে ঝুঁকেছেন।

অন্য ৪টি আসনের মধ্যে বগুড়া-১ আসনে দলের দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাহাদারা মান্নানের নৌকা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর মধ্যে ‘ঈগল’ প্রতীকধারী কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান শ্যামল আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কটির সদস্য এবং ‘তবলা’ প্রতীকধারী শাহজাদী আলম লিপি অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকায় সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ওই দুই প্রার্থীর পাশাপাশি সাবেক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ শোকরানা লড়ছেন ‘কেটলি’ প্রতীক নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্ব›দ্বী তিনজনই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। যে কারণে তারা প্রচার-প্রচারণায় নৌকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বগুড়া-৬ আসনেও নৌকার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছেন দলটির সাবেক নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে তারা আরও একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ক’দিন আগে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দের অনুসারীরা তার ‘ট্রাক’ প্রতীকের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশ থেকে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু এবং তার প্রতীক নৌকার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। ওই সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বগুড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম নৌকা প্রতীকধারী রাগেবুল আহসান রিপুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন এবং কেউ ভোট চুরি করতে আসে তার হাত গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন। আমিনুল ইসলামের ওই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এরই মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। আরেক সাবেক যুবলীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর আব্দুল মতিন সরকার গত উপ নিবাচনে রিপু এমপির পক্ষে কাজ করলেও এবার করছেন আব্দুল মান্নান আকন্দের পক্ষে।

বগুড়া-৭ আসনে আওয়ামী লীগের কেউ দলের মনোনীত প্রার্থী ডা. মোস্তফা আলম নাননুর নৌকার বিপক্ষে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ না হলেও দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত একাধিক নেতা এবং তাদের সমর্থকরা সাবেক বিএনপি নেতা সরকার বাদলের ‘ঈগল’ প্রতীকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। একাধিক সূত্র জানায়, শাজাহানপুর উপজেলার আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের একাধিক নেতা সম্প্রতি গোপনে সরকার বাদলের সঙ্গে বৈঠক করে তাকে বিজয়ী করতে সম্ভাব্য সব কিছু করার প্রতশ্রুতি দিয়েছেন।
বগুড়া-৭ টি আসন ভাগা-ভাগি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট অসন্তোষ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া-৬ আসনের প্রার্থী রাগেবুল আহসান রিপু সাংবাদিকদের বলেছেন,  দলীয় প্রধানের দেওয়া নিদেশনা নেতা-কর্মীরা পালন করে আসছে। দলীয় প্রাথী ও মহাজোট প্রাথীর পক্ষে কাজ করছে নেতাকর্মীরা। বগুড়ার সকল আসনে নৌকা ও মহাজোটের প্রাথীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।