মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে এমন একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। এখন দেশের কোথাও কোথাও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে। শীতজনিত বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এই অবস্থায় মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার ব্যাপারে বেশি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি মশাবাহিত রোগ, পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বেশি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)’র সাবেক সভাপতি ও জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহাবুব বলেন, মশার সঙ্গে শত্রুতা করেই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হবে। এটি মশাবাহিত রোগ, তাই মশার সঙ্গে বসবাস করা যাবে না। মশা যে যে স্থানে বংশবৃদ্ধি করে সেগুলোকে আমাদের ধ্বংস করে দিতে হবে। এটার জন্য মূল কাজ করতে হবে স্থানীয় সরকারের সবাইকে। তারা যদি এগুলো মনিটরিং করে। মশার আড্ডাস্থলগুলো ধ্বংস করে দেয় তাহলে আমরা ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাব। মূলকথা হচ্ছে, ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্যবিদ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্নতা একটা বড় কারণ। আমাদের অপরিচ্ছন্ন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং নির্বাচনের কারণে লেমিনেটেড পোস্টার একেক জায়গায় করা হয়েছে। সেখানে পানি জমেছে। সেগুলোর ইফেক্ট হয়ত আমরা পরে পাব। নগর পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে যারা আছি আমরা তারা এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। ভাবছি যে, এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ময়লা জমা, পানি জমা এগুলো এখন বিপজ্জনক অবস্থায় চলে এসেছে। এই পরিচ্ছন্নতার অভাবে ডেঙ্গু ছাড়াও আরও অন্যান্য রোগ যেগুলো কীতপতঙ্গবাহী রোগ, খাদ্যবাহিত রোগ, পানিবাহিত রোগ এগুলো বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকি বাড়ছে। প্রাচীনকালে যে বিভিন্ন সভ্যতা নষ্ট হয়েছে। এর অনেকের কারণ ছিল অপরিচ্ছন্নতা। ওয়াটার এন্ড স্যানিটেশনের কারণে রোগের প্রকোপ বাড়ায় সেই শহর ছেড়ে মানুষ অন্য জায়গায় পালিয়ে গেছে। সেই শহরগুলো পরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বর্তমান যুগে তো আমরা তেমনটা হবে আশা করি না। আমরা আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। এটি না হলে তো এগুলো আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৮ জন। এরমধ্যে ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছে ৫ জন, ঢাকার বাইরে ১৩ জন। এই বছরের জানুয়ারি থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৯৪৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ৩৩৩ জন। নারী রোগী ৬০৯ জন। এদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছেন ৭৯৮ জন। মারা গেছেন ১৪ জন। এর মধ্যে ৯ জন নারী ও ৫ জন পুরুষ মারা গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৩৩ জন। ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গুর দেখা মেলে ১৯৬৪ সালে। তখন এই অসুখের নাম ছিল ঢাকা ফিভার। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৪৬ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। এ সময় মারা যান ২ হাজার ৫৫৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ৫০ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছে ৪২ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছে ৮ জন রোগী। বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণায় বরাবরই বলেছেন, বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে মশার লার্ভা বৃদ্ধি পায় এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু এখন শীতেও দেশজুড়ে মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, শীত তো জানুয়ারিতে হচ্ছে। মশার জীবনচক্রে মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াতে মাসখানেক সময় লাগে। শীতে অবশ্যই কিছুটা মশা কমার কথা। যেমন ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে মশার বংশ বিস্তার হয় না। ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে মশার ডিম হয় না। এখন যারা মৃত্যুবরণ করছে তারা হয়ত দেড় মাস আগে আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা ডেঙ্গু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো মানুষের মৃতু্যূ হয় না। রোগের পরিস্থিতি খারাপ হলে রোগীর মৃত্যু হয়। এটা এক দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। হয়ত আমরা কিছুদিন পরে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার কম দেখব। আবার তাপমাত্রা বাড়লে এই রোগের প্রকোপও হয়ত বাড়বে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অপরিচ্ছন্নতা দুটো কারণে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে। শীত যখন থেকে শুরু হলো তার দেড় মাস পরে হয়ত আমরা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম পাব। ব্যক্তিগত সতর্কতার উপর জোর দিয়ে ডা. রশীদ-ই-মাহাবুব বলেন, প্রথমত, নিজেকে মশা থেকে দুরে রাখতে হবে। শরীর যেন ঢেকে থাকে এমন কাপড় পরতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিশুদেরও শরীর ঢেকে থাকে এমন কাপড় পরাতে হবে। তৃতীয়ত, ঘুমের সময় অবশ্যই মশারির ভিতরে ঘুমাতে হবে এবং চতুর্থত, রোগতত্ত্ববিদ ও অণুজীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখতে পারেন কোথায় কোথায় এই মশার লার্ভা আছে। তাহলে সেগুলো ধ্বংস করে রক্ষা পেতে পারি। আমি বলব, বর্ষা শীত বলে কথা না, মশা যদি তার বাচ্চা তৈরি করতে পারে তাহলেই এই রোগ। এইক্ষেত্রে তদারকি ও জনসচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। মশা নিধন করেই আমরা এই রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি। যদিও এখন অনেকে বলছে জিনোমগুলো মডিফাই করে আমাদের পক্ষে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
স/ম
























