০৭:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢামেকে টাকা ছাড়া মেলে না হুইল চেয়ার-ট্রলি-শয্যা

প্রতি শয্যায় গুনতে হচ্ছে ৩০০-৫০০ টাকা

রাত বাড়লেই দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ

সিন্ডিকেটেই নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা

 

দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ প্রতিষ্ঠানেই টাকা ছাড়া ঘুরে না ট্রলির চাকা। বকশিস না দিলে মেলে না রোগীদের বহন করার হুইল চেয়ার। সহজে পাওয়া যায় না ওয়ার্ডের শয্যা। রাত বাড়লেই রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। চক্রের সদস্যরাই লালন-পালন করছেন বহিরাগত দালাল। এ চক্রই নানান কৌশলে প্রতিনিয়ত পকেট কাটছে রোগীর স্বজনদের। এর ফলে সেবা নিতে আসা রোগীরা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। অসুস্থ রোগীদের জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ড ও বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য আনা-নেওয়া করতে সরকারিভাবে একজন হুইল চেয়ার বা ট্রলিম্যানও নেই। হয়ত তারই সুযোগ নিচ্ছে একটি মহল। তবে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যালের বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে ২ হাজার ৬০০ শয্যা রয়েছে। তবে রোগী ভর্তি হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এক শিফটে পরিচালিত বহির্বিভাগে গাইনি, শিশু, মেডিসিন, অর্থোপেডিক্স, ক্যান্সার, ইউরোলজি, নাক-কান-গলা, চক্ষু, ডেন্টাল, মেডিসিনসহ ১৭টি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন প্রায় ৪ হাজার রোগী। এসব রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ দিচ্ছেন আরএস ডা. শামসুন্নাহার ওয়াজেদ ও আরপি ডা. শায়েখ আব্দুল্লাহসহ ৬৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন আরও অন্তত ২০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক। বহির্বিভাগে ওয়ার্ড মাস্টার আবুল বাশারের অধীনে আনোয়ারসহ দুজন সর্দারের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছেন ১৪০ জন কর্মচারি। এর মধ্যে ডেইলি বেসিস ৬০ জন ও সরকারিভাবে ৮০ জন কর্মচারি। এর বাইরে ওয়ার্ড মাস্টারের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন বহিরাগত কিরণমালা, পান্না ও সাজেদাসহ ১০-১৫ জন দালাল। এখানে ওটিতে একটি ট্রলি থাকলেও তা রোগীর সেবায় সবসময় নিয়োজিত থাকে না। অধিকাংশ সময়ই থাকে তালা মারা। মাঝেমধ্যে ডাক্তারের পরামর্শে রোগী বহনের ক্ষেত্রে ওই ট্রলি ব্যবহার করা হলেও রোগীর স্বজনদের গুনতে হয় ন্যূনতম ৫০০ টাকা। এছাড়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কমিশন বাণিজ্যের উদ্দেশে রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাইরের ডায়াগণস্টিক সেন্টারে। এদিকে জরুরি বিভাগ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি ও প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন দুই-তিন হাজার রোগী। জরুরি বিভাগে তিন শিফটে প্রতিদিন ৩০ জন কর্মচারি থাকার কথা থাকলেও ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজের তত্ত্বাবধানে সর্দার স্বপনের অধীনে কাজ করেন ১১ জন। এর মধ্যে ডেইলি বেসিস ছয় জন ও সরকারি পাঁচ জন কর্মচারি রয়েছেন। হুইল চেয়ার কিংবা ট্রলিতে চেপে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় জরুরি বিভাগে। অথচ ডাক্তার অব্দি পৌঁছাতে ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের বয়, নার্স কিংবা সর্দারদের সিন্ডিকেট করে ট্রলি আর হুইল চেয়ার বাণিজ্য। সরকারি সম্পদ হলেও রোগীর স্বজনেরা যেন এসব ব্যবহার করতে না পারেন সেজন্য তালা মেরে রাখা হয় ট্রলি আর হুইল চেয়ারে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢামেক হাসপাতালে নতুন পরিচালক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বদলে যায় জরুরি বিভাগের দৃশ্যপট। রোগী হয়রানি ও দুর্ভোগ রোধে জরুরি বিভাগের বহিরাগত ট্রলিম্যান ও দালালদের বিতাড়িত করা হয়। এতে উৎকোচবঞ্চিত ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ ও সর্দার স্বপনসহ ১১ জন কর্মচারি নিজেদের ইচ্ছেমতো দ্বায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি এসব কর্মচারিরা জরুরি বিভাগে অবস্থান করলেও শিগগির কোনো রোগী বা ট্রলি টেনে ধরেন না। হাসপাতালের ভেতর কেবিন ব্লকে কাজী সাঈদ, বার্নে ফজলুল করিম, নতুন ভবনে ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজ ও জিল্লুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে মো. দীনা ১২ জন কর্মচারি কাজ করছেন। নির্ধারিত সময় ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিগণ প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও ওয়ার্ড মাস্টরদের ম্যানেজ করে মাসিক হারে মাসোহারা দিয়ে হরহামেশাই হাসপাতালে ঢুকে পড়ছেন তারা। পুরাতন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেন। এছাড়া মোকলেস, আবু হানিফ, আব্দুল গফুর, বাবুল ও স্বপনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে সব মিলে রয়েছে ৩০ জনের মতো সর্দার। প্রতিটি ওয়ার্ড মাস্টারের অধীনে কাজ করেন তিন জন সর্দার। এরা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট গড়ে প্রকাশ্যে ট্রলি-হুইল চেয়ার ও সিট বাণিজ্য করে চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হুইল চেয়ার নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় ১৫ থেকে ২০ জন নারী। এদের মধ্যে পারুল, শারমিন, মমতাজ, রত্না ও শাহানাজ অন্যতম। তাদের লক্ষ্য থাকে, রোগীদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে টাকা আদায় করা। এর মধ্যে পারুল চাহিদামতো টাকা না পেলে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। মো. শামিম নামের ট্রলিবয় জানান, হাসপাতালে অন্তত ৩০০ জন লোক ট্রলি টানছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টায় সার্ভিস দিয়ে থাকেন তারা। হাসপাতাল থেকে তাদের এক টাকাও দেওয়া হয় না। রোগীর স্বজনরা খুশি হয়ে যা দেন তাই নিই।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা জানান, পরিচিত কেউ না থাকলে সরকারি হাসপাতালে টাকা ছাড়া চিকিৎসাসেবা পাওয়া অনেক কষ্টকর। জরুরি বিভাগ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওয়ার্ডে ভর্তি করা পর্যন্ত রোগী প্রতি ধাপে ধাপে সবমিলিয়ে বখশিস দিতে হয় অন্তত ১ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ওয়ার্ড বয়দের হাতে তুলে দিলেই মিলে যায় কাক্সিক্ষত সিট। তা না হলে মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয় রোগীদের। দিনের বেলায় যেমন-তেমন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতালে আগত রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে আরো কয়েকগুণ। ঢামেক কর্মচারি ফজলুল করিম বলেন, ঢাকা মেডিক্যালে ২৫ থেকে ৩০ জন সর্দার আছে। ট্রলি ও হুইল চেয়ার টানার জন্য যারা আছে তাদের আমরা তিন শিফটে ভাগ করে দিয়েছি। এদের দেখভাল আমাদেরই করতে হয়। রোগীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ের বিষয়টি সত্য নয়। চিকিৎসকরা জানান, রোগীসেবার ব্রত নিয়েই সবাইকে কাজ করা উচিৎ। এছাড়া হাসপাতালে প্রশিক্ষিত ট্রলিম্যান থাকা অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করার বিষয়টি একেবারেই অমানবিক। জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারি সমিতির (ঢামেক শাখা) সভাপতি ও নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। ফলে তার কোনো বক্তব্য মেলেনি। এদিকে গতকাল বিকালে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তার কোনো সাড়া মেলেনি। তবে তিনি ক্ষুদে বার্তায় বলেছেন ‘আমি কিছুক্ষণ পর কলব্যাক করছি’।

 

 

 

স/ম

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢামেকে টাকা ছাড়া মেলে না হুইল চেয়ার-ট্রলি-শয্যা

আপডেট সময় : ১২:০২:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

প্রতি শয্যায় গুনতে হচ্ছে ৩০০-৫০০ টাকা

রাত বাড়লেই দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ

সিন্ডিকেটেই নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা

 

দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ প্রতিষ্ঠানেই টাকা ছাড়া ঘুরে না ট্রলির চাকা। বকশিস না দিলে মেলে না রোগীদের বহন করার হুইল চেয়ার। সহজে পাওয়া যায় না ওয়ার্ডের শয্যা। রাত বাড়লেই রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এ হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। চক্রের সদস্যরাই লালন-পালন করছেন বহিরাগত দালাল। এ চক্রই নানান কৌশলে প্রতিনিয়ত পকেট কাটছে রোগীর স্বজনদের। এর ফলে সেবা নিতে আসা রোগীরা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। অসুস্থ রোগীদের জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ড ও বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য আনা-নেওয়া করতে সরকারিভাবে একজন হুইল চেয়ার বা ট্রলিম্যানও নেই। হয়ত তারই সুযোগ নিচ্ছে একটি মহল। তবে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যালের বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে ২ হাজার ৬০০ শয্যা রয়েছে। তবে রোগী ভর্তি হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এক শিফটে পরিচালিত বহির্বিভাগে গাইনি, শিশু, মেডিসিন, অর্থোপেডিক্স, ক্যান্সার, ইউরোলজি, নাক-কান-গলা, চক্ষু, ডেন্টাল, মেডিসিনসহ ১৭টি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন প্রায় ৪ হাজার রোগী। এসব রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ দিচ্ছেন আরএস ডা. শামসুন্নাহার ওয়াজেদ ও আরপি ডা. শায়েখ আব্দুল্লাহসহ ৬৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন আরও অন্তত ২০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক। বহির্বিভাগে ওয়ার্ড মাস্টার আবুল বাশারের অধীনে আনোয়ারসহ দুজন সর্দারের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছেন ১৪০ জন কর্মচারি। এর মধ্যে ডেইলি বেসিস ৬০ জন ও সরকারিভাবে ৮০ জন কর্মচারি। এর বাইরে ওয়ার্ড মাস্টারের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন বহিরাগত কিরণমালা, পান্না ও সাজেদাসহ ১০-১৫ জন দালাল। এখানে ওটিতে একটি ট্রলি থাকলেও তা রোগীর সেবায় সবসময় নিয়োজিত থাকে না। অধিকাংশ সময়ই থাকে তালা মারা। মাঝেমধ্যে ডাক্তারের পরামর্শে রোগী বহনের ক্ষেত্রে ওই ট্রলি ব্যবহার করা হলেও রোগীর স্বজনদের গুনতে হয় ন্যূনতম ৫০০ টাকা। এছাড়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কমিশন বাণিজ্যের উদ্দেশে রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাইরের ডায়াগণস্টিক সেন্টারে। এদিকে জরুরি বিভাগ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি ও প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন দুই-তিন হাজার রোগী। জরুরি বিভাগে তিন শিফটে প্রতিদিন ৩০ জন কর্মচারি থাকার কথা থাকলেও ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজের তত্ত্বাবধানে সর্দার স্বপনের অধীনে কাজ করেন ১১ জন। এর মধ্যে ডেইলি বেসিস ছয় জন ও সরকারি পাঁচ জন কর্মচারি রয়েছেন। হুইল চেয়ার কিংবা ট্রলিতে চেপে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় জরুরি বিভাগে। অথচ ডাক্তার অব্দি পৌঁছাতে ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের বয়, নার্স কিংবা সর্দারদের সিন্ডিকেট করে ট্রলি আর হুইল চেয়ার বাণিজ্য। সরকারি সম্পদ হলেও রোগীর স্বজনেরা যেন এসব ব্যবহার করতে না পারেন সেজন্য তালা মেরে রাখা হয় ট্রলি আর হুইল চেয়ারে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢামেক হাসপাতালে নতুন পরিচালক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বদলে যায় জরুরি বিভাগের দৃশ্যপট। রোগী হয়রানি ও দুর্ভোগ রোধে জরুরি বিভাগের বহিরাগত ট্রলিম্যান ও দালালদের বিতাড়িত করা হয়। এতে উৎকোচবঞ্চিত ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ ও সর্দার স্বপনসহ ১১ জন কর্মচারি নিজেদের ইচ্ছেমতো দ্বায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি এসব কর্মচারিরা জরুরি বিভাগে অবস্থান করলেও শিগগির কোনো রোগী বা ট্রলি টেনে ধরেন না। হাসপাতালের ভেতর কেবিন ব্লকে কাজী সাঈদ, বার্নে ফজলুল করিম, নতুন ভবনে ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজ ও জিল্লুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে মো. দীনা ১২ জন কর্মচারি কাজ করছেন। নির্ধারিত সময় ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিগণ প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও ওয়ার্ড মাস্টরদের ম্যানেজ করে মাসিক হারে মাসোহারা দিয়ে হরহামেশাই হাসপাতালে ঢুকে পড়ছেন তারা। পুরাতন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেন। এছাড়া মোকলেস, আবু হানিফ, আব্দুল গফুর, বাবুল ও স্বপনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে সব মিলে রয়েছে ৩০ জনের মতো সর্দার। প্রতিটি ওয়ার্ড মাস্টারের অধীনে কাজ করেন তিন জন সর্দার। এরা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট গড়ে প্রকাশ্যে ট্রলি-হুইল চেয়ার ও সিট বাণিজ্য করে চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হুইল চেয়ার নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় ১৫ থেকে ২০ জন নারী। এদের মধ্যে পারুল, শারমিন, মমতাজ, রত্না ও শাহানাজ অন্যতম। তাদের লক্ষ্য থাকে, রোগীদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে টাকা আদায় করা। এর মধ্যে পারুল চাহিদামতো টাকা না পেলে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। মো. শামিম নামের ট্রলিবয় জানান, হাসপাতালে অন্তত ৩০০ জন লোক ট্রলি টানছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টায় সার্ভিস দিয়ে থাকেন তারা। হাসপাতাল থেকে তাদের এক টাকাও দেওয়া হয় না। রোগীর স্বজনরা খুশি হয়ে যা দেন তাই নিই।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা জানান, পরিচিত কেউ না থাকলে সরকারি হাসপাতালে টাকা ছাড়া চিকিৎসাসেবা পাওয়া অনেক কষ্টকর। জরুরি বিভাগ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওয়ার্ডে ভর্তি করা পর্যন্ত রোগী প্রতি ধাপে ধাপে সবমিলিয়ে বখশিস দিতে হয় অন্তত ১ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ওয়ার্ড বয়দের হাতে তুলে দিলেই মিলে যায় কাক্সিক্ষত সিট। তা না হলে মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয় রোগীদের। দিনের বেলায় যেমন-তেমন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতালে আগত রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে আরো কয়েকগুণ। ঢামেক কর্মচারি ফজলুল করিম বলেন, ঢাকা মেডিক্যালে ২৫ থেকে ৩০ জন সর্দার আছে। ট্রলি ও হুইল চেয়ার টানার জন্য যারা আছে তাদের আমরা তিন শিফটে ভাগ করে দিয়েছি। এদের দেখভাল আমাদেরই করতে হয়। রোগীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ের বিষয়টি সত্য নয়। চিকিৎসকরা জানান, রোগীসেবার ব্রত নিয়েই সবাইকে কাজ করা উচিৎ। এছাড়া হাসপাতালে প্রশিক্ষিত ট্রলিম্যান থাকা অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করার বিষয়টি একেবারেই অমানবিক। জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারি সমিতির (ঢামেক শাখা) সভাপতি ও নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। ফলে তার কোনো বক্তব্য মেলেনি। এদিকে গতকাল বিকালে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তার কোনো সাড়া মেলেনি। তবে তিনি ক্ষুদে বার্তায় বলেছেন ‘আমি কিছুক্ষণ পর কলব্যাক করছি’।

 

 

 

স/ম