- পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকদের ভোগান্তি বেশি
- বিকাশ-বিদ্যুতে সমন্বয়হীনতা, ভোগান্তিতে গ্রাহক
- ভুল বিলে গ্রাহকের পকেট থেকে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা
- গ্রামের মানুষ বেশি প্রতারণার শিকার
- হিসাবে ভুল-গরমিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার
- সেবার নামে বিভিন্ন চার্জে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা
- অভিযোগ নিয়ে গেলে তাচ্ছিল্যের শিকার গ্রাহকরা
বিল বেশি করে সিস্টেম লস কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে সাধারণ গ্রাহক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন -এম শামসুল আলম জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
বিদ্যুৎ বিল নিয়ে দেশজুড়ে যেন চলছে তুগলকিকাণ্ড। ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে বিদ্যুতের বিল। বিল পরিশোধ করার পরও গ্রাহককে ধরিয়ে দেওয়া হয় বকেয়া বিলের ফর্দ। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ভুলেভরা বিলে দিশাহারা গ্রাহকরা। অভিযোগ করেও মিলছে না সুরাহা। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত ও সরল মানুষ এভাবেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এভাবে মাসের পর মাস অতিরিক্ত বিল দিয়ে আসছেন গ্রাহকরা। একদিকে নিত্যপণ্যে অস্বাভাবিক দাম অন্যদিকে বিদ্যুতের এমন তেলেসমাতি বিলকাণ্ড দেখে দিশাহারা গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ খাতের ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) বিদ্যুৎ বিলে অভিযোগের পাহাড় গ্রাহকদের। প্রতিকার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হাজারো ভুক্তভোগী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এলাকাধীন গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিল গুনতে হচ্ছে। প্রতি মাসেই অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ গ্রাহকদের। ঈশ্বরগঞ্জ জোনাল অফিসের বেশ কিছু একটি বিলের কাগজ আসে সবুজ বাংলার কাছে। বিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ বিলেই হিসাবে গরমিল রয়েছে। বকেয়া বিল পরিশোধ করেও পরবর্তি মাসে ফের বকেয়া বিল দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকের লক্ষ লক্ষ টাকা। এভাবে নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। প্রতি মাসে বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করছেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নের আতাউর রহমান (ছদ্মনাম)। তার হিসাব নং ১০৬৪০৮০৫৮১০৫১। তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২২৪ টাকা বিল পরিশোধ করেন। অক্টোবরে মাসে দেখা গেল আগের মাসের বিলের সাথে নতুন বিল সংযুক্ত করা। এরপর নভেম্বর মাসেও আগের দুই মাসের বিল হিসাব করে নতুন বিল তৈরি করেছে। গত এপ্রিল
মাসের বিলে দেখা গেল তার পরিশোধ করা ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসের বিলকে বকেয়া ধরে
নতুন বিল তৈরি করেছে। পরে তিনি অভিযোগ করলে ৫৪৯ টাকার বিল ১০৩ টাকায় নেমে
এসেছে। ময়মনসিংগের সম্বুগঞ্জ জোনাল অফিসের আওতাধীন গ্রাহক মাহাবুবুল আলম ও
আব্দুল মান্নান নামের দুইজন গ্রাহকের বিলের কাগজেও এমন গোঁজামিল দেখা গেছে।
তাদের বিদ্যুতের হিসাব নং যথাক্রমে ১০৬৪০২০৫৮৭০৫০ ও ১০৬৪০২০৮১৭৬৫।
তাদের অভিযোগ বিল পরিশোধ করার পরও বকেয়া বিলের হিসাব বারবার গুণতে হয়।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ
অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাদের কাছে গ্রাহকরা কোনো অভিযোগ করেন না।
তিনি সবুজ বাংলাকে বলেন, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়। বিলের ক্ষেত্রে ভুল হলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে সুরাহ করব। নিয়মিত ভুল হওয়াকে তিনি
স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার খোকন, দিপু, সলিমসহ বেশ কয়েকজন গ্রাহক ভুলভাল বিলের বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, ভুলভাল বিলের অভিযোগ
নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। মিলছে না কোনো সুরাহা। অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা গুরুত্ব দেয় না। বিরক্ত হন বিদ্যুতের কর্মকর্তারা। কোনো কোনো কর্মকর্তা গ্রাহকদের সাথে অসদাচারণও করছেন বলে জানা গেছে। যা বিল আসে তাই পরিশোধ করতে হবে না হলে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাও হুমকি দেওয়া হয়। এতে অসহায় হয়ে পড়ে গ্রাহকরা। এদিকে বিকাশ অ্যাপে বিল পরিশোধ করার পরও চলতি হিসাব থাকে না। বিকাশ ও
বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগও উঠেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে
পড়েন সাধারণ গ্রাহকরা।
বিদ্যুৎ বিলের এমন ছলচাতুরির বিষয়ে কথা হয় নালিতাবাড়ি উপজেলার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আক্তারুজ্জানের সঙ্গে। গ্রাহকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সবুজ বাংলাকে তিনি বলেন, আমাদের গ্রাহক অনেক। অনেক কাজের মধ্যে ভুল হওয়া ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ বলে চালিয়ে দিতে চান তিনি। অথচ গ্রাহকদের অভিযোগ মাসের পর মাস বছরের পর বছর এমন ভুল বিলের আলোকে টাকা দিতে হয় গ্রাহকদের। ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, অনেক সময় রিডিংয়ে ভুল তথ্য
আসে। তাই বিলে ভুল হয়।
তবে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিলের টানা ভুলকে স্বাভাবিক ঘটনা বলতে নারাজ। গ্রাহকদের অভিযোগ বিলের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদ্যুতের কতিপয় কর্মকর্তারা। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন
করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যুৎ বিলের কাগজে হিসাব মিলছে না অধিকাংশ গ্রাহকের। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি বিলে অতিরিক্ত টাকা যোগ করে দেওয়া হয়েছে। বিলের কপিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিপরীতে ভ্যাট, বিলম্ব মাশুল যোগ করেও চূড়ান্ত বিলের সঙ্গে গরমিল পাওয়া গেছে। এমন ভুতুড়ে বিল নিয়ে বিপাকে গ্রাহকেরা। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিল নিয়ে অফিসে ঘোরার পরও কোনো সমাধান দিতে পারছেন না সমিতির লোকজন। আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির লোকজনের দাবি, গত মাসের মাঝামাঝিতে বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে। সফটওয়্যারে সক্রিয়ভাবে সেটি যোগ হওয়ার কারণে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ফুলতলা গ্রামের নাছিমা বেগমের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে ১০০ কিলোওয়াট। বিদ্যুতের মূল্য অনুযায়ী ১০০ কিলোওয়াটের মূল্য ৫৭৫, এর সঙ্গে ডিমান্ড চার্জ ৪২, মিটার ভাড়া ১০, ডাবল ভ্যাট ৭২ টাকা যুক্ত করে বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৯৯ টাকা। অথচ সর্বমোট বিল দেখানো হয়েছে ৭৬২ টাকা। ৬৩ টাকা বিল অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে। ওই গ্রাহকের অভিযোগ, বিলটিতে হিসাবে গরমিল থাকলেও তাকে ৭৬২ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। অফিসকে জানানোর পরও সমাধান হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ শুধু নাছিমা বেগমেরই নয়, উপজেলার আটটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাহকের একই অভিযোগ।
উপজেলার ভাঙ্গামিল এলাকার তসলিম উদ্দীন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, বাড়ির মিটারে ৯ হাজার টাকা অতিরিক্ত যোগ করে বিল ইস্যু করে পাঠিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। বিল ইস্যু হলেই পরিশোধ করতে বাধ্য গ্রাহক- এমন অদ্ভুত নিয়ম এই দপ্তরের। ভুল নিজেদের হলেও সেটার দায় গ্রাহকের ওপর চাপানো হয়। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় বিদ্যুৎ বিলে গরমিলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিলের কাগজে কোথাও যোগের ভুল, কোথাও গুণের ভুল কোথাও বা অযাচিত বকেয়া বিল গ্রাহকের ঘাড়ে তুলে দিচ্ছে বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। পল্লী বিদ্যুতের এক গ্রাহক জানান, ২০১০ সালের জুন মাসের বিল বকেয়া দেখিয়ে আমাকে ২০২৩ সালে নোটিস পাঠিয়েছিল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। অথচ তাদের দেওয়া প্রত্যয়ন রয়েছে আমার কাছে, ওই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অভিযোগ তো অনেক আছে, সমাধান করার কেউ নেই।
রাজধানীর রায়েরবাগের বাসিন্দা ডিপিডিসির গ্রাহক আতিকুর রহমান বলেন, কয়েক মাস ধরেই বিদ্যুতের বিল বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, প্রি-পেইড মিটারে এক হাজার টাকা রিচার্জ করি। এতে এজেন্ট চার্জ ১০ টাকা, পাঁচ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে ৪৭ টাকা, রিবেট এক শতাংশ হিসেবে সাত টাকা, ছয় মাসের মিটার চার্জ ২৪৬ টাকা এবং ডিমান্ড চার্জ ৪২০ টাকা কেটে নেয়। ‘বিভিন্ন চার্জে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা’ যুক্ত করেন তিনি।
রাজধানীর অন্য এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, মে মাসে পুরো এসি চালিয়েও বিল এসেছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এপ্রিল মাসে তা বেড়ে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। জুলাইয়ে এসি খুব কম চালানোর পরও বিল এসেছে ৬ হাজার ৮০০ টাকা। তিনি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) গ্রাহক। ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিরুদ্ধে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের গ্রাহকদের বিল বেশি করলেও সে বিষয়ে তারা তেমন অভিযোগ করেন না।
বিদ্যুতের এমন ভুতুড়ে বিলের বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ বিল নিয়ে নানা অভিযোগই পাওয়া যাচ্ছে। নতুন নতুন অভিযোগ আরও আসবে। বিদ্যুৎ বিভাগ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লস কমাতে নিয়মিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেয়। কিন্তু
বিতরণ ব্যবস্থাপনার তো সেভাবে উন্নতি হয়নি। ফলে সিস্টেম লস তেমন কমে না। কিন্তু বছর শেষে সাফল্য দেখাতে বেশি বেশি বিল করে সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানো হয়। এত
সাধারণ গ্রাহক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সচেতন হওয়া উচিত।






















