◉সংসার চালাতে রীতিমতো ঋণের চক্রে পড়ছেন অনেকে
◉মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে কাজে আসেনি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ
◉মৌলিক চাহিদাতেও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ
◉শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীই নয়, মধ্যবিত্তরাও জীবনযাত্রার যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছেন
➤মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপও সংকট উসকে দিয়েছে- ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ
➤মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ, অর্থনীতিবিদ
নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একের পর এক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। লাগাতার বাড়ছে ডলারের দাম। বাড়ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়ছে সার্বিক পণ্যমূল্যে। মূল্যস্ফীতির পারদ এখনো অসহনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। প্রতিনিয়ত একের পর এক সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি সব মানুষের আয়। বরং আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বাড়ার কারণে সংসারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মৌলিক চাহিদাতেও রীতিমতো কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীই নয়, মধ্যবিত্তরাও জীবনযাত্রার যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছেন। এদিকে মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তাতে তেমন লাভ হয়নি, বরং মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির লাগামসহ সব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে বাজেটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী। এতে করে ডলারের দামও দিন দিন বাড়ছে। আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আইএমএফের বিপিএম ৬ হিসাবে, দেশে রিজার্ভ রয়েছে ১৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এতে ডলারের মূল্যে অস্থিরতা বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত মে মাসে দেখা যায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে পৌঁছেছে। যা গত এপ্রিলে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। গত মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ হয়েছে। এপ্রিলে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। তবে অর্থবছরের গত ১১ মাসের কোনো মাসেই এ হারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। দুই বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ সময় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি এক ধরনের কর; ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতি। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে গরিব ও মধ্যবিত্তরা সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়ে। গত দুই বছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
শুধু খাদ্যপণ্য নয়, শিক্ষাসামগ্রীর দামও বেড়েছে। বেড়েছে যানবাহন ব্যয়। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারেও খরচ আগের চেয়ে বাড়তি। চিকিৎসাসেবা ও ওষুধেও ব্যয় বেড়েছে হু-হু করে। তেল, সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যবহার্য পণ্যের পেছনে খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পোশাক ও বিনোদন খরচ। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে না উঠে অনেকে মৌলিক চাহিদাতেও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রতিনিয়ত বাজার খরচে হিমশিম খাচ্ছেন পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা তাওহিদা জান্নাত। তিনি বলেন, বাসাবাড়িতে কাজ করে যে সামান্য আয়, তা বাড়ি ভাড়া আর বাজার খরচ সামাল দিতেই ‘নাই’ হয়ে যায়। চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মেটানো যায় না। বাধ্য হয়ে ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছে। তাদের কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এরপরও এ শহরে টিকে থাকতে প্রতিমাসেই ঋণ করতে হচ্ছে।
জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মনির। তিনি বলেন, রীতিমতো ঋণ করতে হচ্ছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রতিটি খাতে খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বেড়েছে। এমনকি ওষুধের দামটা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ বেতন বাড়ে না। সীমিত আয়ে সব খরচ সামাল দিয়ে চিকিৎসা কিংবা বিনোদনে কোনো খরচই করতে পারছি না। সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি। এমনকি সাশ্রয়ী হতে মাছ-মাংস খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছি। পোশাকে খরচ কমিয়েছি। এরপরও পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ঋণ করতে হচ্ছে। ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই সংকট ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ করা হয়নি। অপরদিকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোরও বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গতি না থাকলে সেটা আরও বেশি সমস্যা তৈরি করে। মূল্যস্ফীতি কমাতে এতদিন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা কাজে তো আসেইনি, বরং সংকট উসকে দিয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কৃষকদের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী এখন যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে এগুলো আরও অনেক আগে থেকেই নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে এতটা চাপ অনুভূত হতো না।
























