রাজধানীতে রেলে কাটা পড়ে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। সবশেষ গত বুধবার সাকালে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে মালবাহী কন্টেইনার ট্রেনের ধাক্কায় এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম হাবিবুর রহমান (৭৯)। ঢাকা রেলওয়ে থানার বিমানবন্দর ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সানু মং মারমা জানান, বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে খিলক্ষেত রেল ক্রসিং দিয়ে অসতর্কভাবে রেললাইন পারাপারের সময় মালবাহী কন্টেইনার ট্রেনের ধাক্কায় মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম পেয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ওই বৃদ্ধ।
রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ-কমলাপুর-বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত ৫৮টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টির কোনো অনুমোদন নেই। এছাড়া এ রেলপথে ছোট আকারের আরও প্রায় ৩০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ গেন্ডারিয়া, মগবাজার, কুড়িল ও উত্তরার লেভেল ক্রসিং। যেগুলোর একেকটি যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত ৬ মাসে ঢাকা রেলওয়ে থানার অন্তর্ভুক্ত এলাকায় রেলে কাটা পড়ে ১৬২ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার অধিকাংশই এপথে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অরক্ষিত রেলক্রসিং আর অসচেতনতায় ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কেউ চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে, কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সিøপারে পা আটকে, কেউ ট্রেন থেকে নামতে ও রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের নিচে প্রাণ হারাচ্ছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ। তারপরও নেই সচেতনতা। আর সচতেন মহল বলেছে, মানুষের সচেতনতা ছাড়াও গাফলতি আছে কর্তৃপক্ষেরও। অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করা এবং যাত্রী-পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে কোনো উদ্যোগ নেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে রেলে ৫১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৭৫ জন যাত্রী-পথচারী। সংস্থাটি বলছে, গেটম্যান ও সিগন্যাল বারে দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতায় রেললাইনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বাড়ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রেলের অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিং নির্মাণরোধ করাসহ নানারকম সিদ্ধান্ত নিলেও এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ফলে, প্রতিদিনই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে দেশের লেভেলক্রসিংগুলো।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে অটোম্যাটিক সিগন্যাল ও রেলের সাইরেনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, এখন আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ট্রেন আসার আগে যেন একটা লাইট জ্বলে সতর্কতা সৃষ্টি করা যায় বা সাইরেন বাজিয়ে বোঝানো যায় তেমন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেত, তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া বাজার, মালিবাগ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাইকারি বাজার। বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলার রেলক্রসিং পার হচ্ছেন তারা। মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেন দেখেও মাথায় বস্তা নিয়ে দৌড় দিলেন আরেক দোকানি। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ। এতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন তারা। ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ লেভেলক্রসিংয়ের একই চিত্র দেখা গেছে। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও অবাধে পার হয়ে যান তারা। শ্যাওড়া রেলক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক গেটম্যানরা সতর্কীকরণ সাইরেন বাজালেও তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারও।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০০ মানুষ মারা যায়। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট এলাকায় চলাচল আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই সীমানার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে তাকে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। এমনকি ওই সীমানায় গবাদিপশু প্রবেশ করলে তা বিক্রি করে এর অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। রেললাইনে দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যে আছে, অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে হাঁটাচলা ও পারাপার। রেল মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বৈঠকে দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক রেলক্রসিংয়ের পরিবর্তে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ, অননুমোদিত রেলক্রসিং বন্ধ করার কথা বলা হয়।
ঢাকা রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ^াস বলেন, ঢাকা রেলওয়ে থানার অন্তর্ভুক্ত ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। দীর্ঘ এই রেলপথে প্রায়ই অনকাঙ্খিত দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছেন পথচারীরা। বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় অসেচতনাতার কারণে হচ্ছে। গত ৬ মাসে রেলে কাটা পরে মৃত্যু হয়েছে ১৬২ জনের। এরমধ্যে নারী, পুরুষ, শিশু রয়েছে। রেলওয়ের বিধি বিধান মেনে চলতে সর্বসাধারণের প্রতি অনুরোধ।
























