০২:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের : বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম

◉ সিন্ডিকেটের কবলেই নিত্যপণ্যের বাজার
◉ দুই মাসে দাম বেড়েছে পাঁচটি পণ্যের, কমেছে দুটির
◉ সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দামে
◉ অভিযানের খবরে পালিয়ে গেলেন ডিম ব্যবসায়ীরা

╰┈➤ জিনিসপত্রের দাম কমাতে কাজ করছে সরকার : বাণিজ্য উপদেষ্টা
╰┈➤ ব্যবসায়ীরা আগের মতো সিন্ডিকেট করে সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে : ড. জাহাঙ্গীর আলম খান, অর্থনীতিবিদ
╰┈➤ ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে : ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছিল। সরকারের পতনের পর কয়েকদিন বাজারে সবকিছুর দাম কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে সেই আগের অবস্থায় ফিরে এসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরও গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। পণ্যের দাম মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলের সেই সিন্ডিকেট ভাঙার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রমের দেখা মেলেনি এখনো। এরই মধ্যে ডিম-মুরগির সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। সরকারের অগ্রাধিকারে থাকলেও বাজারব্যবস্থায় এখনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি। বাজারের তথ্য বলছে, গত দুই মাসে ডিম, মুরগি, সবজি, কাঁচামরিচ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দাম। এছাড়া প্রধান খাদ্যশস্য চালের যে চড়া দাম ছিল, সেটাও বরং আরও একটু বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বন্যাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এ সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানান প্রভাব পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় পড়েছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ সুফল পায়নি। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে পণ্যের দাম বাড়া-কমার কিছু যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণ আছে। এর মধ্যে সুদের হারে লাগাম তুলে নেওয়ায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমে পণ্যের চাহিদা কমছে। এতে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর নিত্যপণ্যের সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় দুই মাসে পাঁচটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র দুটির। বেড়েছে তেল, চিনি, ডিম, মুরগি ও চালের দাম। কমেছে পেঁয়াজ ও আলুর। টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৮ আগস্টের তুলনায় গত রোববার মোটা চাল কেজিতে ১ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৬ টাকা, চিনি ৩ টাকা, ডিম হালিতে ৮ টাকা, ব্রয়লার মুরগিতে ২০ টাকা বেড়েছে। আর পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে কমেছে ৫ টাকা।
এ সময় বেশ কিছু সবজি ও কাঁচামরিচের দাম বেশি ছিল, তবে এসব পণ্য টিসিবির হিসাবে নেই। পাশাপাশি এ সময় ভরা মৌসুমে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে ইলিশ মাছ। সেটাও সাধারণ মানুষের বড় উষ্মার কারণ। পণ্যের দাম কমাতে পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক প্রত্যাহার করেছিল এ সরকার। যার দীর্ঘদিন পেরিয়ে পেঁয়াজের দাম সামান্য কমেছে এখন। যদিও এ সরকারের শুল্ক প্রত্যাহার ও এর মধ্যে ভারতের শুল্ক কমানোর তুলনায় সেটা খুব নগণ্য। বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সবজি। এখন পেঁপে ছাড়া অন্য কোনো সবজি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। এছাড়া কাঁচামরিচের দাম প্রায় ওঠানামা করছে। একদিন ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হলে পরদিন ৩০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে চারশ টাকায়।

যদিও বিক্রেতারা বলছেন, টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে সবজির সরবরাহ কমেছে। অনেক সবজি ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া এখন গ্রীষ্ম মৌসুমের সবজিগুলোর সরবরাহ শেষ দিকে, আর শীত মৌসুমের আগাম সবজির সরবরাহ কম। দুই মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এখন দাম বাড়ছে।
বাজার করতে আসা খাদিজা নামে একজন স্বল্প আয়ের মানুষ বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল নতুন সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু নানা খাতে সংস্কার হলেও দ্রব্যমূল্য কমিয়ে স্বস্তি দিতে পারেনি। যে কারণে আমাদের মতো কম আয়ের মানুষ এখনো কষ্টে আছে।

কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আরমান আলী বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুম শেষ, শীত মৌসুম শুরুর আগের এই সময়টি প্রতি বছর সবজির দাম একটু বেশিই থাকে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোতে এখন সবজির দাম বেশি।’
বাজার ব্যবস্থার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি ডলার সংকট কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্যও সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন।
ডিমে আবার ‘সিন্ডিকেট’ : সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছে, এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছিল। শুল্ক কমিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বেঁধে দেওয়া দামে কিনতে পারেননি ভোক্তারা।
সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে মুরগিও বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে এখনো। রাজধানীতে ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ব্রয়লার মুরগির নির্ধারিত দর প্রতি কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা এবং সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা। এছাড়া এ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে ডিম আমদানি শুরু করেছে। তাতেও নামছে না দাম। এই মুহূর্তে বাজারে সবচেয়ে অস্থিতিশীল পণ্য ডিমের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের বড় অভিযোগ এসেছে। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলেছে, ডিম ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে গত ২০ দিনে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা লুট করেছেন করপোরেট ব্যবসায়ীরা। সংস্থাটি বলেছে, মূল্যবৃদ্ধিতে করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের কারণে ডিম এবং মুরগির বাজারে অস্থিরতা। এই চক্র বারবার বাজারে কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিলেও তাদের শাস্তি হচ্ছে না। এ কারণে বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলছে বলে দাবি করা হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার : জিনিসপত্রের দাম কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। তবে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি যেমন একদিনে বাড়েনি, কমতেও সময় লাগবে।
তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ১ শতাংশ কমেছে। সরকারের পদক্ষেপে এ ফল মিলেছে। মূল্যস্ফীতি কমার ব্যাপারে সময় লাগবে। তবে কিছুটা স্বস্তি আনবে। এরই মধ্যে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছি। আজকেই চিনির ওপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হলো।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। আশা করি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বন্যার কারণেও বেড়েছে দাম : দেশের দক্ষিণের ১১ জেলায় আগস্টের বন্যা অন্তত ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেছে বলে ধারণা দিয়েছে সিপিডি। বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ক্ষতির ওই অংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। বন্যায় কৃষি ও বন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার ১৬৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এটি মোট ক্ষতির ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যার একটি বড় প্রভাব বাজারে কৃষিপণ্যের দামে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়েছে, এটা পণ্যমূল্যে একটি বড় প্রভাব ফেলছে সত্য। আবার এর মধ্যে কিছুদিন ব্যাংক দেনদেনের একটি লিমিট ছিল, ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেননি। এসব কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে যে পরিমাণ সমস্যা হচ্ছে, পাশাপাশি কিছু সুবিধাও রয়েছে। আগের মতো চাঁদা ও অন্যান্য খরচ এখন নেই। তবে সে সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আগের মতো সিন্ডিকেট করে সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।
অভিযানের খবরে পালিয়ে গেলেন ডিম ব্যবসায়ীরা : ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির বাজারদর নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অভিযানের খবর পেয়ে দোকান বন্ধ করে আগেই সটকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বুধবার ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুকের নেতৃত্বে রাজধানীর কাপ্তান বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত বাজার মনিটরিংয়ের টাস্কফোর্স এ অভিযান চালায়। এ সময় খুচরা দোকানদারদের অনেকে ডিম লুকিয়ে ফেলেন। তাদের কাছে ডিম নেই বলে দাবি করেন।
তবে ব্রয়লার মুরগির দোকানে অভিযান চালিয়ে কেজি প্রতি বেশি মূল্যে মুরগি বিক্রি ও মূল্য তালিকা না থাকায় দুই ব্যবসায়ীকে সাত হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। রুহুল ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার ও কাওসার ট্রেডার্সকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, কাপ্তান বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি ও সদস্যদের বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে বেশি মূল্যে বিক্রি না করা ও মূল্য তালিকা সংরক্ষণ করার জন্যে মিটিং ডেকে সবাইকে সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংবলিত সাইনবোর্ড বাজার কমিটি ৭ দিনের মধ্যে টানাবে যাতে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ জনসাধারণ সচেতন হয়। টাস্কফোর্সের বাজার মনিটরিং অব্যাহত থাকবে।
এ সময় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (অধিদপ্তরে সংযুক্ত) রফিকুল ইসলাম, ক্যাবের তথ্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ার পারভেজ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফারহান আতেফ, মো. সালাউদ্দিনন, আব্দুল জব্বার মন্ডল, ঢাকা জেলা কার্যালয়ের জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের সহকারী পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

মেঘনায় দুই লঞ্চের সংঘর্ষে ৮ জন নিহত

দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের : বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম

আপডেট সময় : ০৮:১১:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

◉ সিন্ডিকেটের কবলেই নিত্যপণ্যের বাজার
◉ দুই মাসে দাম বেড়েছে পাঁচটি পণ্যের, কমেছে দুটির
◉ সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দামে
◉ অভিযানের খবরে পালিয়ে গেলেন ডিম ব্যবসায়ীরা

╰┈➤ জিনিসপত্রের দাম কমাতে কাজ করছে সরকার : বাণিজ্য উপদেষ্টা
╰┈➤ ব্যবসায়ীরা আগের মতো সিন্ডিকেট করে সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে : ড. জাহাঙ্গীর আলম খান, অর্থনীতিবিদ
╰┈➤ ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে : ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছিল। সরকারের পতনের পর কয়েকদিন বাজারে সবকিছুর দাম কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে সেই আগের অবস্থায় ফিরে এসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরও গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। পণ্যের দাম মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলের সেই সিন্ডিকেট ভাঙার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রমের দেখা মেলেনি এখনো। এরই মধ্যে ডিম-মুরগির সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। সরকারের অগ্রাধিকারে থাকলেও বাজারব্যবস্থায় এখনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি। বাজারের তথ্য বলছে, গত দুই মাসে ডিম, মুরগি, সবজি, কাঁচামরিচ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দাম। এছাড়া প্রধান খাদ্যশস্য চালের যে চড়া দাম ছিল, সেটাও বরং আরও একটু বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বন্যাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এ সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানান প্রভাব পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় পড়েছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ সুফল পায়নি। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে পণ্যের দাম বাড়া-কমার কিছু যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণ আছে। এর মধ্যে সুদের হারে লাগাম তুলে নেওয়ায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমে পণ্যের চাহিদা কমছে। এতে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর নিত্যপণ্যের সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় দুই মাসে পাঁচটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র দুটির। বেড়েছে তেল, চিনি, ডিম, মুরগি ও চালের দাম। কমেছে পেঁয়াজ ও আলুর। টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৮ আগস্টের তুলনায় গত রোববার মোটা চাল কেজিতে ১ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৬ টাকা, চিনি ৩ টাকা, ডিম হালিতে ৮ টাকা, ব্রয়লার মুরগিতে ২০ টাকা বেড়েছে। আর পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে কমেছে ৫ টাকা।
এ সময় বেশ কিছু সবজি ও কাঁচামরিচের দাম বেশি ছিল, তবে এসব পণ্য টিসিবির হিসাবে নেই। পাশাপাশি এ সময় ভরা মৌসুমে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে ইলিশ মাছ। সেটাও সাধারণ মানুষের বড় উষ্মার কারণ। পণ্যের দাম কমাতে পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক প্রত্যাহার করেছিল এ সরকার। যার দীর্ঘদিন পেরিয়ে পেঁয়াজের দাম সামান্য কমেছে এখন। যদিও এ সরকারের শুল্ক প্রত্যাহার ও এর মধ্যে ভারতের শুল্ক কমানোর তুলনায় সেটা খুব নগণ্য। বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সবজি। এখন পেঁপে ছাড়া অন্য কোনো সবজি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। এছাড়া কাঁচামরিচের দাম প্রায় ওঠানামা করছে। একদিন ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হলে পরদিন ৩০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে চারশ টাকায়।

যদিও বিক্রেতারা বলছেন, টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে সবজির সরবরাহ কমেছে। অনেক সবজি ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া এখন গ্রীষ্ম মৌসুমের সবজিগুলোর সরবরাহ শেষ দিকে, আর শীত মৌসুমের আগাম সবজির সরবরাহ কম। দুই মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এখন দাম বাড়ছে।
বাজার করতে আসা খাদিজা নামে একজন স্বল্প আয়ের মানুষ বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল নতুন সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু নানা খাতে সংস্কার হলেও দ্রব্যমূল্য কমিয়ে স্বস্তি দিতে পারেনি। যে কারণে আমাদের মতো কম আয়ের মানুষ এখনো কষ্টে আছে।

কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আরমান আলী বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুম শেষ, শীত মৌসুম শুরুর আগের এই সময়টি প্রতি বছর সবজির দাম একটু বেশিই থাকে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোতে এখন সবজির দাম বেশি।’
বাজার ব্যবস্থার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি ডলার সংকট কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্যও সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন।
ডিমে আবার ‘সিন্ডিকেট’ : সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছে, এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছিল। শুল্ক কমিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বেঁধে দেওয়া দামে কিনতে পারেননি ভোক্তারা।
সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে মুরগিও বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে এখনো। রাজধানীতে ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ব্রয়লার মুরগির নির্ধারিত দর প্রতি কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা এবং সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা। এছাড়া এ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে ডিম আমদানি শুরু করেছে। তাতেও নামছে না দাম। এই মুহূর্তে বাজারে সবচেয়ে অস্থিতিশীল পণ্য ডিমের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের বড় অভিযোগ এসেছে। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলেছে, ডিম ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে গত ২০ দিনে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা লুট করেছেন করপোরেট ব্যবসায়ীরা। সংস্থাটি বলেছে, মূল্যবৃদ্ধিতে করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের কারণে ডিম এবং মুরগির বাজারে অস্থিরতা। এই চক্র বারবার বাজারে কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিলেও তাদের শাস্তি হচ্ছে না। এ কারণে বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলছে বলে দাবি করা হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার : জিনিসপত্রের দাম কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। তবে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি যেমন একদিনে বাড়েনি, কমতেও সময় লাগবে।
তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ১ শতাংশ কমেছে। সরকারের পদক্ষেপে এ ফল মিলেছে। মূল্যস্ফীতি কমার ব্যাপারে সময় লাগবে। তবে কিছুটা স্বস্তি আনবে। এরই মধ্যে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছি। আজকেই চিনির ওপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হলো।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। আশা করি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বন্যার কারণেও বেড়েছে দাম : দেশের দক্ষিণের ১১ জেলায় আগস্টের বন্যা অন্তত ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেছে বলে ধারণা দিয়েছে সিপিডি। বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ক্ষতির ওই অংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। বন্যায় কৃষি ও বন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার ১৬৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এটি মোট ক্ষতির ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যার একটি বড় প্রভাব বাজারে কৃষিপণ্যের দামে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়েছে, এটা পণ্যমূল্যে একটি বড় প্রভাব ফেলছে সত্য। আবার এর মধ্যে কিছুদিন ব্যাংক দেনদেনের একটি লিমিট ছিল, ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেননি। এসব কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে যে পরিমাণ সমস্যা হচ্ছে, পাশাপাশি কিছু সুবিধাও রয়েছে। আগের মতো চাঁদা ও অন্যান্য খরচ এখন নেই। তবে সে সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আগের মতো সিন্ডিকেট করে সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।
অভিযানের খবরে পালিয়ে গেলেন ডিম ব্যবসায়ীরা : ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির বাজারদর নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অভিযানের খবর পেয়ে দোকান বন্ধ করে আগেই সটকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বুধবার ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুকের নেতৃত্বে রাজধানীর কাপ্তান বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত বাজার মনিটরিংয়ের টাস্কফোর্স এ অভিযান চালায়। এ সময় খুচরা দোকানদারদের অনেকে ডিম লুকিয়ে ফেলেন। তাদের কাছে ডিম নেই বলে দাবি করেন।
তবে ব্রয়লার মুরগির দোকানে অভিযান চালিয়ে কেজি প্রতি বেশি মূল্যে মুরগি বিক্রি ও মূল্য তালিকা না থাকায় দুই ব্যবসায়ীকে সাত হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। রুহুল ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার ও কাওসার ট্রেডার্সকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, কাপ্তান বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি ও সদস্যদের বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে বেশি মূল্যে বিক্রি না করা ও মূল্য তালিকা সংরক্ষণ করার জন্যে মিটিং ডেকে সবাইকে সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংবলিত সাইনবোর্ড বাজার কমিটি ৭ দিনের মধ্যে টানাবে যাতে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ জনসাধারণ সচেতন হয়। টাস্কফোর্সের বাজার মনিটরিং অব্যাহত থাকবে।
এ সময় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (অধিদপ্তরে সংযুক্ত) রফিকুল ইসলাম, ক্যাবের তথ্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ার পারভেজ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফারহান আতেফ, মো. সালাউদ্দিনন, আব্দুল জব্বার মন্ডল, ঢাকা জেলা কার্যালয়ের জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের সহকারী পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।