সিলেটের গ্রামীণ ইউনিয়ন থেকে শুরু করে নগরীর আবাসিক মহল্লা—সবখানেই জন্মসনদে বয়স কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। মাত্র ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার বিনিময়ে ১৫–১৬ বছরের কিশোরীকে জন্মনিবন্ধনে ‘১৮ বছর পূর্ণ’ দেখিয়ে বৈধ প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে দেওয়ার অন্ধকার ব্যবসা এখন যেন বাল্যবিয়েকে বৈধতার মুখোশ পরিয়ে দিচ্ছে।
মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য—অনেক কিশোরীর প্রকৃত বয়স ১৪–১৫ হলেও কাগজে ১৮ দেখিয়ে নিয়মিতভাবে বিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে। শহরের আবাসিক এলাকাও এই চক্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কাগজপত্রে সব ঠিক থাকায় প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপ কঠিন হয়ে পড়ছে—ফলাফল, বয়স জালিয়াতির আড়ালে বাল্যবিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
জন্মনিবন্ধনে বয়স কারচুপি কোনো সাধারণ ভুল নয়; এটি কিশোরীদের শৈশব, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কেড়ে নেওয়া একটি সংগঠিত প্রতারণা। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু চোখের সামনে বড় হতে বাধ্য হচ্ছে বিয়ে, গর্ভধারণ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকারে।
এ রকম এক উদাহরণ নবম শ্রেণির ছাত্রী মারজিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সে প্রেমের সম্পর্কের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিয়ে করে। তার বাবা জানান—“আমার মেয়ের বয়স ১৫। কিন্তু জন্মনিবন্ধনে বয়স ১৮ বছর দেখানো হয়েছে। তাই আমরা কিছুই করতে পারিনি।”
নগরীর গোয়াইপাড়া এলাকার মৌ আক্তার ও হৃদয় আহমদ দম্পতি—যাদের প্রকৃত বয়স ১৮ হয়নি—তারা ইতোমধ্যেই একটি সন্তানের বাবা-মা। তাদের দাবি, জন্মনিবন্ধনে বয়স ‘যথাযথ’ থাকায় বিয়েটিও নাকি বৈধ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে—বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। এক ইউনিয়নে ছয় মাসে ৭২টি বয়স সংশোধনের আবেদন এসেছে, যার ৬০ শতাংশই মেয়েদের। অনেক পরিবারের একাধিক মেয়ের জন্মতারিখ হঠাৎ কয়েক বছর এগিয়ে যাওয়াও এখন সাধারণ বিষয়। ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের সামনে দাঁড়ালেই শোনা যায়—“বিয়ার কাজ আছে, বয়সটা বাড়াইয়া দেন।”
খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন—“পঞ্চম–ষষ্ঠ শ্রেণির অনেক ছাত্রছাত্রী হঠাৎ স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরে জানতে পারি—তাদের জন্মনিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে।”
৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের সদস্য আতাউর রহমান শামিম বলেন, “জন্মনিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়াটা এখন খুব সাধারণ ঘটনা। এই চক্র রোধ করতে প্রশাসন ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের আরও কঠোর নজরদারি জরুরি।”
অল্প বয়সে বিয়ে ও মাতৃত্ব কিশোরীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন—“অতিরিক্ত কম বয়সে গর্ভধারণে গর্ভপাত, রক্তক্ষরণ, অপুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মানসিকভাবে শিশুরা ভেঙে পড়ে।”
সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন—“বয়স জালিয়াতির কারণে কিশোরী মায়েদের পাশাপাশি তাদের নবজাতকও মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে। পুরো প্রজন্মও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।”
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন—“জন্মনিবন্ধনের জন্মতারিখ আইনগতভাবে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কেউ নতুন জন্মনিবন্ধন বানিয়ে বয়স পরিবর্তন করলে তা সরাসরি জালিয়াতি। জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে বাল্যবিয়ে রোধ অসম্ভব।”
এমআর/সবা
























