রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসংক্রান্ত বিভিন্ন ফি জমা দিতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মুখে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হচ্ছে তাদের। এই অব্যবস্থাপনার দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের ওপর চাপিয়েছেন প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক ও মন্নুজান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আসিয়ারা খাতুন। তবে অভিযোগটি সরাসরি নাকচ করেছেন আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ছাইফুল ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেমিস্টার পরীক্ষার আগে আবাসিক হলগুলোতে ইউনিয়ন ফি, ক্রীড়া ফি, লাইব্রেরি ফি, ইন্টারনেট ফি ও বিবিধ খাতে অর্থ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি প্রথম বর্ষের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের এককালীন ১,৪০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। পূর্বে এসব অর্থ একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ম্যানুয়ালি জমা দেওয়া হতো।
পরবর্তীতে ‘ই-রেজাল্ট অটোমেশন’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনলাইনে ফি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়ে দপ্তরটি সেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায় এবং পুনরায় হল প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।
পুনরায় দায়িত্ব পেয়ে হলগুলো একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আলাদা আলাদা খাতে ফি জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেয়, পূর্বে যেখানে একটিমাত্র অ্যাকাউন্টে জমা দিলেই চলত। ফলে ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয় চরম ভিড় ও বিশৃঙ্খলা, যার ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়।
এ নিয়ে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি ব্যাংকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার কারণ তুলে ধরে দাবি করেন, আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অপারগতা প্রকাশ করায় অনলাইন পদ্ধতি বন্ধ করা হয়েছে। পোস্টে তিনি আরও অভিযোগ করেন, আইসিটি সেন্টারের পরিচালক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েও পদে বহাল রয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলো সমাধানে উদাসীন ভূমিকা পালন করছেন।
ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, আজ (১৯ ডিসেম্বর) ব্যাংকে যে হুড়োহুড়ি সেটার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানের একটা সামারি করি তারপর আপনারা কারে গালি দিবেন সেটা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েন। ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ফি দিতে পেরেছে তারপর আবার সে আগের কাহিনী শুরু হয়েছে। ইউনিয়ন ফি, ক্রিড়া ফি, লাইব্রেরি ফি, ইন্টারনেট ফি, বিবিধ সবকিছুর আলাদা আলাদা রিসিট, আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। যেহেতু এটা আগে অনলাইনে ছিল তাই আজকের এই বিষয়টা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক ম্যামকে কল দিলে জানতে পারি আইসিটি পরিচালক নাকি অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
তিনি আরও লিখেছেন, উনি (আইসিটি সেন্টারের পরিচালক) যদি অপারগতা প্রকাশ করে তাইলে ওনার ওই জায়গায় থাকার কী দরকার? আমি গেলে এখন লাগবে মারামারি, এমনিতেই ম্যানারলেস থার্ডক্লাস একটা লোক। আমাকে নিয়ে দিন রাত পোস্ট করে বেড়ায়। ওয়াইফাই ঠিক করতে রাকসুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক তার কাছে গেলে সে উলটো রাকসুর সম্পাদককে ৪ কোটি টাকার বাজেট হাতে ধরাইয়া দিছে। এই বেসিক কাজগুলো করবেও না আবার বেহায়ার মতো চেয়ারে বসে থাকবে। আমি গেলে লাগবে মারামারি। এজন্য আপনারা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় না দেখতে চাইলে নিজেরাই প্রতিবাদ করেন। দায়িত্ব নিয়ে নিজেরে বড় শমসের ভাবা মানুষের সাথে আমার মোলাকাত একটু অন্যভাবেই হয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ছাইফুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষার সময়ে হলের ফি অনলাইনে দেওয়া বিষয়ে আইসিটি সেন্টারের অপারগতার দাবি ডাহা মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। হল প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক মহোদয় এ বিষয়ে তো দূরে থাক, কোনো বিষয়েই আমার সাথে কথা বলেননি। হলের ফি নেওয়ার বিষয়ে আইসিটি সেন্টার কোনোভাবেই জড়িত নয়।
তবুও তিনি কীভাবে আমার উপর দায় চাপালেন সেটা তাঁকে জিজ্ঞাসা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমি মুঠোফোনে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে বলেছেন— তিনি চাপের মুখে হঠাৎ করেই এ কথা বলে ফেলেছেন। আমার প্রতি এমন অপবাদ দেওয়ায় আমাকে সরি বলেছেন। তিনি মনে করেছিলেন এটার দায়িত্ব আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের। যাহোক তিনি আমাকে সরি বলেছেন, এজন্য আমি এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাচ্ছি না।
জানতে চাইলে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, শিক্ষার্থীদের হল ফি জমা দিতে যে ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে, তা জানার পর আমি প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ও মন্নুজান হলের প্রভোস্টকে ফোন করি। তিনি আমাকে জানান, গত বছর হল ফি জমার ক্ষেত্রে অটোমেশন পদ্ধতি চালু ছিল, কিন্তু এবার সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আইসিটি সেন্টারের প্রশাসক অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে তারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না জানিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেন, এই বিষয়টি যেন কাউকে না জানানো হয়।
দায়িত্ব না থেকেও আইসিটি সেন্টারের পরিচালককে নিয়ে পোস্ট করার বিষয়ে তিনি বলেন, হল প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক ম্যাম আমাকে যে তথ্য জানিয়েছেন আমি সেটা নিয়েই পোস্ট করেছি। আপনার (সাংবাদিক) মাধ্যমে শুনলাম এই বিষয়ে আইসিটি সেন্টারের পরিচালক জড়িত নয়। তাহলে ম্যাম কেন আমাকে এই মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন সে বিষয়ে আমি অবশ্যই তাঁকে জিজ্ঞাসা করব।
প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ও মন্নুজান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আসিয়ারা খাতুন বলেন, গত বছর অটোমেশন পদ্ধতি চালু থাকায় শিক্ষার্থীরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজেই সব ধরনের ফি জমা দিতে পেরেছিল। তবে চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই অটোমেশন পদ্ধতি ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। কেন এটি বন্ধ করা হয়েছে এ বিষয়ে আইসিটি দপ্তরের প্রশাসকের কাছে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেননি। শুধু জানান, দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই অটোমেশন পদ্ধতি বন্ধ করা হয়েছে।
আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের উপর দায় চাপানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আইসিটি দপ্তরের প্রশাসককে কল করি এবং অটোমেশন পদ্ধতি কেন বন্ধ রাখা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাই। তিনি আমাকে জানান, তাঁরা নাকি কোনো ধরনের অপারগতা দেখাচ্ছেন না। তখন আমি তাকে বলি, যদি আপনারা অপারগতা না দেখান, তাহলে এভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা আমার জন্য ঠিক হয়নি।

























