পুরোনো রূপে ফিরছে উপজেলা নির্বাচন। এ লক্ষ্যে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় প্রথমবারের মতো সাদা-কালো পোস্টার ছাপানোর নিয়ম ঠিক করে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী রঙিন পোস্টার ছাপালে তা আচরণবিধি লঙ্ঘন ধরে নেওয়া হয়। দীর্ঘ বিরতির পর এবার বিধি পরিবর্তন করে নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহৃত ব্যানার-পোস্টার রঙিন ছাপানোর অনুমতি দিতে চাইছে ইসি।
সম্প্রতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধিতে বড় পরিবর্তন আনতে কমিশন যে খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে রঙিন পোস্টারের বিষয়টি জানা গেছে। এছাড়া ডিজিটাল প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি, প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই প্রচারের সুযোগ দেওয়া, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিধান বাতিলসহ একগুচ্ছ বড় পরিবর্তন আনতে চায় কমিশন।
চলতি মাসেই সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতিবেদন কমিশন সভায় উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। এসব প্রস্তাবে ইসি সম্মত হলে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ ভোটেই নতুন আইন কার্যকর হতে পারে বলে জানান তিনি। অবশ্য আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির সভাপতি নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, পুরো বিষয়টিই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এটা নিয়ে এখনও কিছু হয় নাই। কিছু বলা যাচ্ছে না। একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আগে হোক তারপরে আপনাদের ডেকে জানাব।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন (আচরণ বিধিমালা) ২০১৬ এ আটটি সংশোধনী প্রস্তাব এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা-২০১৩ এ ২৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যবহৃত পোস্টারে পলিথিনের আবরণ ও প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে কমিশন। সাদা-কালো পোস্টার ব্যবহার করে প্রচার কাজ চালানো থেকে সরে প্রার্থীদের রঙিন পোস্টার বা ব্যানার ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায় কমিশন। এছাড়া প্রার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রচারের সুযোগ দিতে চায় কমিশন। কমিশন চায় বিদ্যমান নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধিমালা মেনে প্রার্থী কিংবা তাদের নির্বাচনী এজেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার চালানোর সুযোগ পাক। তবে এ ক্ষেত্রে প্রার্থী কিংবা তার এজেন্টকে সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, একাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ সনাক্তকরণ তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত আকারে জমা নেওয়ার বিধানের কথাও ভাবা হচ্ছে। বর্তমান আচরণবিধি অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো প্রার্থীই প্রচারে নামতে পারেন না। তবে প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে চায়। প্রতীক বরাদ্দের আগে জনসংযোগ ও ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ দিতে বিধান সংশোধন করতে চায় কমিশন। কোনো প্রার্থী পাঁচজনের বেশি সমর্থক সঙ্গে নিয়ে জনসংযোগ করতে পারবেন না।
উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ এর বিধি ২ (১৭) অনুযায়ী, জনসংযোগ বলতে বোঝানো হয়েছেÑ একজন প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ, সাক্ষাৎ বা পরিচিত হওয়া কিংবা ভোটারদের মধ্যে লিফলেটসহ নির্বাচনী প্রচারপত্র বিতরণকে। শব্দের মানমাত্রা ও মাইক্রোফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কমিশন। শব্দদূষণ প্রতিরোধে নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যবহৃত মাইকিং বা শব্দ বর্ধনকারী যন্ত্রে শব্দের মানমাত্রা ৬০ ডেসিবেলের নিচে রাখার বিধান রাখতে চায়। এছাড়া জনসভায় সর্বোচ্চ চারটি মাইক ব্যবহারের বিষয়েও চিন্তা চলছে।
এতদিন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনসভা ও মিছিলের বিষয়ে আলাদা বিধান ছিল না। সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা ২০০৮ বিধি ৬ এর মতো স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনেও জনসভা ও মিছিলের বিধান যুক্ত করতে চায় কমিশন। বর্তমান আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ২০ হাজার ভোটারের হারে একটির বেশি এবং সর্বোচ্চ পাঁচটির বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প বা অফিস স্থাপন করতে পারেন না।
কমিশনের খসড়ায় প্রতি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় ক্যাম্প বা অফিস স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিয়নে একটি এবং পৌরসভা এলাকায় প্রতি তিনটি ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প বা অফিস স্থাপনের সুযোগ দিয়ে বিধান সংযুক্ত করতে চায় কমিশন। নির্বাচনী ক্যাম্পের আয়তন ৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি করার চিন্তাও চলছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী অপরাধ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনজনিত বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের জন্য নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সংখ্যক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মনিটরিং কমিটি গঠন করতে চায়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি লঙ্ঘনজনিত ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে- এমন বিধানও খসড়ায় আছে।
বর্তমানে সরাসরি ও অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়ন দাখিলের বিধান রয়েছে। সরাসরি জমা দেওয়ার বিধান থেকে সরে এসে অনলাইনেই মনোনয়ন জমা নেওয়ার কথা ভাবছে কমিশন। উপজেলায় নির্বাচনের ব্যয়সীমার ক্ষেত্রে বিধিমালার ৫১ এ বলা হয়েছে, প্রার্থীরা ব্যক্তিগত খরচ বাবদ ১ লাখ ভোটার সংবলিত পরিষদের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা। ১ লাখ থেকে ২ লাখ ভোটার সম্বলিত পরিষদের ক্ষেত্রে ৭৫ হাজার টাকা এবং ২ লাখের বেশি ভোটার হলে অনধিক ১ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। অনধিক ১ লাখ ভোটার সম্বলিত পরিষদের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যয় এখন ৫ লাখ টাকা। ১ লাখের থেকে অনধিক ২ লাখ ভোটারের ক্ষেত্রে অনধিক ৭ লাখ টাকা। ২ লাখের অধিক ভোটারের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারছেন প্রার্থীরা। তবে এসব বিধিমালায় সংশোধনী আনতে চায় কমিশন।
খসড়ায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান বা মহিলা সদস্য পদে নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্তদের হুমকি দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চায় কমিশন। নির্বাচনী প্রচারের জন্য প্রার্থীদের আরো বেশি সময় দিতে চায় কমিশন। বর্তমান বিধি অনুযায়ী, ভোটের দিনের তিন সপ্তাহ আগে কোনো ধরনের প্রচার শুরু করা যায় না। তবে এবার প্রতীক বরাদ্দের আগেই গণসংযোগ শুরুর অনুমতি দিতে চায় কমিশন। বর্তমানে সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারের মুড়িতে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। এবার কমিশন উপজেলা ভোটেও এই নিয়ম যুক্ত করতে চায়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ২৫ এর বিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও প্রিজাইডিং অফিসারকে ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা ভাবছে কমিশন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংরক্ষিত প্রতীক তফসিলে অন্তর্ভুক্তির কোনো বিধান নেই। এবার কমিশন তা সংশোধন করে বিধানটি যুক্ত করতে চায়।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটগ্রহণের আগে কোনো প্রার্থীর মতু্যু হলে নির্বাচন কার্যক্রম বাতিল করে নতুন করে ভোট করতে হয়। আবার সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটগ্রহণের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী মারা গেলে বাকিদের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রয়েছে।
সংশোধনী প্রস্তাবে কমিশন চায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা ভাইস-চেয়ারম্যান বা সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটের আগে কোনো প্রার্থীর মৃতু্যু হলে অন্যদের নিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করতে। তবে যদি একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অবশিষ্ট থাকেন, সেক্ষেত্রে নির্বাচন কার্যক্রম বাতিল করে নতুন ভোটের তারিখ ঘোষণা করা যেতে পারে। এমনকি কোনও রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ভোটগ্রহণের ১০ দিন আগে মারা গেলে ওই দলকে নতুন প্রার্থী মনোনয়নের সুযোগ দেওয়ার কথাও ভাবছে কমিশন।
এছাড়া নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ থেকে তিন মাস পার হওয়ার পর নির্বাচনী মালামাল ও দলিলপত্র নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ থেকে এক বছর সময় অতিক্রমের পর মালামাল ও দলিলপত্র নিষ্পত্তির বিধান করার কথা ভাবছে কমিশন। কমিশন ফলাফল স্থগিত ও পুনরায় ভোটগ্রহণের জন্যও বিধান যুক্ত করত।
নির্বাচনে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সমান সংখ্যক ভোট পেলে নতুন করে ভোটগ্রহণের পদ্ধতি থেকে সরে এসে লটারির মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করতে চায় কমিশন। কোনও নির্বাচনী এলাকার কোনও প্রার্থী সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে পাওয়া ভোটের আট ভাগের একভাগ অর্থাৎ ১২ দশমিক ৫ শতাংশের কম ভোট পেলে তার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে। এখানে পরিবর্তন এনে প্রাপ্ত ভোটের ৬ ভাগের একভাগ অর্থাৎ ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশের কম ভোট পেলেই কেবল জামানতের টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার বিধান যুক্তের কথা ভাবছে কমিশন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা দাখিলের বিধান বাতিল করা হতে পারে। গোপন কক্ষে ভোট দেওয়ার আগেই কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি বাতিল করার কথা ভাবছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর দেওয়া জামানতের পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে।
উপজেলায় একাধিক পদে নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান নেই। একজন ব্যক্তি একই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক পদে যেন মনোনয়ন দাখিল করতে না পারেন, তেমন বিধান যুক্ত করতে চায় কমিশন। এছাড়া উপজেলা ভোটের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিধান যুক্ত করতে চায় কমিশন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী অপরাধ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের জন্য নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মনিটরিং কমিটি গঠন করার কথা ভাবছে। মনিটরিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আচরণবিধি লঙ্ঘনজনিত ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে চায় ইসি। বর্তমানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান বা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে জামানত হিসেবে ১০ হাজার টাকা এবং মহিলা সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এখন এটি ২ লাখ ও ৫০ হাজার টাকা করার কথা ভাবছে কমিশন।





















