- আট মাসে উদ্ধার ২৬ কোটি টাকার স্বর্ণবার
- এ সময়ে গ্রেপ্তার ১৮ চোরাকারবারি
- এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা
দিন যত গড়াচ্ছে, ততোই ঘণিয়ে আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্র্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এই উৎসবকে সামনে রেখে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে স্বর্ণপাচার বেড়েছে। দেশের পটপরিবর্তনে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে দেশি-বিদেশি স্বর্ণ চোরাকাররারিরা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে চক্রের সদস্যরা অভিনব কৌশল হিসেবে পরিধেয় পোশাকের এক লেয়ারে প্রলেপণ করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে স্বর্ণ আনছে। দেশে স্বর্ণ বিক্রিতে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্বর্ণ বিক্রিতে ৩ শতাংশ ভ্যাট দেওয়ায় চোরাকারবারিরা অবৈধভাবে আনা স্বর্ণগুলো ভারতেই পাচার করছে। বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণগুলো কয়েকভাবে বিভক্ত করে হাতবদল হয়ে নানা কৌশলে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। ভারতে স্বর্ণের চাহিদা থাকায় চক্রের সদস্যরা তা সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচার করে দিচ্ছে। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এই উৎসব ঘিরে ভারতে স্বর্ণ বেচাকেনার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চলতি সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে অক্টোবরে টানা সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠেয় দুর্গাপূজাকে টার্গেট করে এখন থেকেই স্বর্ণ চোরাকারবারিরা নিরাপদ রুট হিসেবে জল-স্থলপথে সীমান্ত এলাকাকেই বেছে নিচ্ছে। সম্প্রতি বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে নিয়োজিত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। চলতি বছরের গত ৮ মাসে দেশের সীমান্তসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৬ কোটি টাকার স্বর্ণবার উদ্ধারমূলে জব্দ করা হয়েছে। এ সময়ে ১৮ জন চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। যশোরের মানবাধিকার সংগঠন রাইটস’র নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিকের মতে, প্রায়ই দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে যাচ্ছে স্বর্ণ, আর এর বিনিময়ে এপারে আসছে মাদকসহ অবৈধ পণ্যসামগ্রী। তবে পাচারের মূল হোতারা ধরা না পড়ায় সীমান্ত অপরাধ বেড়েই চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর নজরদারি না থাকার সুযোগ নিচ্ছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। স্বর্ণ পাচারে টালমাটালে রয়েছে সীমান্ত এলাকাগুলো। তবে যশোর বিজিবি’র ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলছেন, দেশের সীমান্ত সুরক্ষায় আন্তরিকভাবে কাজ করছে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা। অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ ভারতে স্বর্ণ পাচার ও মাদকসহ অন্যান্য অবৈধ পণ্যসামগ্রী প্রায়ই জব্দ করা হচ্ছে। চোরাচালানে জড়িত মূল হোতাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জানা যায়, পঞ্জিকা অনুসারে- আগামী ২১ সেপ্টেম্বরে মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠী, ২৯ সেপ্টেম্বর সপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর অষ্টমী ১ অক্টোবর নবমী ও ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুর্গোৎসব। এরপর আগামী ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে লক্ষ্মীপূজা। এই পূজা ঘিরে ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বর্ণের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। তবে দুর্গাপূজা শুরুর আগে সেপ্টেম্বর থেকেই দেশের সীমান্ত এলাকা ও বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন রুটে স্বর্ণ পাচাররোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকায় চোরাকারবারিরা নানা কৌশলে স্বর্ণ পাচারে তৎপরতা বাড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন যত গড়াচ্ছে, ততোই ঘণিয়ে আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্র্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এই উৎসবকে সামনে রেখে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে স্বর্ণপাচার বেড়েছে। পাচারের অর্থ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে। দেশের পটপরিবর্তনে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোকে বেছে নিয়ে নিজস্ব সোর্স বসিয়ে হাতবদলসহ নানা কৌশলে স্বর্ণের বড় বড় চালান দেশের ওপারে পাচার করছে। এতে ক্রমেই সীমান্ত এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দেশে-বিদেশে অবস্থান নেওয়া মূল হোতারা আড়ালে থেকে অনলাইন-অফলাইনে যোগাযোগ রক্ষা করে স্বর্ণের চালান দেশে এনে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও চক্রের প্রধানরা অধরাই থেকে যাচ্ছেন। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর ফলে স্বর্ণ আটকও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজিবি’র ৪৯ ও ২১ ব্যাটালিয়নের পৃথক অভিযানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭ কেজি ৪৩৪ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৩ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ সময় গ্রেফতার হয়েছে ১৮ জন চোরাকারবারি। তবে পাচারের মূল হোতারা এখনও ধরা পড়েনি।
সীমান্ত সূত্রগুলো বলছে, প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগেই ভারতীয় বাজারে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ফলে পাচারকারীরা যশোরের বেনাপোল, কুড়িগ্রামের ভুড়ুঙ্গামারী, কুমিল্লার আখাউড়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, ফেনীর সীমান্ত রুটকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে। চক্রের সদস্যরা কখনও সীমান্তপথে হেঁটে, কখনও আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ট্রাক কিংবা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের মাধ্যমে স্বর্ণ পাচার করছে। চক্রটি মূলত দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও আফ্রিকা থেকে বিমানযোগে স্বর্ণের এসব চালান এনে ঢাকায় পৌঁছায়। পরে ট্রেন ও বাসে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে ভারতে পাচার করছে।
সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরে দুর্গাপূজাকে টার্গেট করে চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার বাড়িয়েছে। চোরাকারবারিরা সাধারণত পূজার তিন মাস আগে স্বর্ণ পাচার বাড়ায়। বাস-ট্রেনে স্বর্ণ পাচার হতে পারে এমন খবরে স্থলপথ ও রেলপথে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এবং বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় স্বর্ণ পাচার হচ্ছে বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আসন্ন দুর্গাপূজা সামনে রেখে এবার বাস-ট্রেনেই সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ পাচারের চেষ্টা চলছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই চোরাচালান প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সীমান্তের বিভিন্ন বন্দরের চোরাচালান দলের সদস্য এবং ইমিগ্রেশন ও বাস-রেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চোরাই স্বর্ণ পায়ুপথে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিয়েও ট্রেনে করে ভারতে পাচার করার চেষ্টা চলছে। চোরাচালান দলের সদস্যরা ভারতগামী বাস-ট্রেনে যাত্রী সেজে থাকে। পাচারের সময় চক্রের বেশ কয়েকজন একসঙ্গে বাস-ট্রেনে থাকলেও তখন কেউ কাউকে চেনেন না। একই ব্যক্তিকে দিয়ে বারবার এ কাজ করানো হয় না। প্রতি চালানে দলের সদস্য পরিবর্তন করা হয়। দলের সদস্যরা নেতাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। এসব কাজ করার জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থের লেনদেন করা হয়। তবে বেশির ভাগ লেনদেন হয় হুন্ডিতে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিঙ্গাপুর-দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর দিয়ে পাচার করা স্বর্ণ মিথ্যা ঘোষণায় বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছানোর পর চোরাচালান দলের সদস্যরা ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে আনে। তারা চোরাচালান দলের অন্য সদস্যদের হাতে স্বর্ণ বুঝিয়ে দেয়। বুঝে পাওয়া স্বর্ণ দেশের মধ্যে গোপন স্থানে রাখা হয়। অনেক সময় এগুলো অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে সেখানে স্বর্ণ রাখা হয়। তবে এসব ব্যক্তি চোরাচালান দলের নেতাদের খোঁজ জানে না। চোরাচালান চক্রের নেতারা সব সরকারের সময়েই দেশের মধ্যে প্রভাবশালী। তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে চোরাচালানপর্ব যথেষ্ট নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের অন্যতম বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তিন-চার মাস আগে থেকেই ব্যবসার পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ করেন। এ সময় ক্রেতার পছন্দ বিবেচনায় রেখে বাজারে স্বর্ণের গহনার সরবরাহ বাড়ান ব্যবসায়ীরা। একইভাবে মিথ্যা ঘোষণায় ভারতে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে সীমান্তের ৩০ জেলা দিয়েও চোরাইপথে ভারতে স্বর্ণ যাচ্ছে। বিশেষভাবে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে।
দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাংলাদেশে স্বর্ণ বিক্রিতে ভ্যাট ৫ শতাংশ, ভারতে ৩ শতাংশ। বেশি লাভ করতে চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ অবৈধভাবে ভারতে নিয়ে বিক্রি করছে। ফলে চোরাচালানি বাড়ছে। বাজুসের তথ্যানুসারে, বছরে ৯৫ হাজার কোটি টাকার স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালান হয়।
জানা যায়, দুর্গাপূজার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই দুই দেশেরই (ভারত ও বাংলাদেশ) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন তৎপরতা বাড়ায়। এ সময়ে নজরদারি বেশি থাকায় চোরাচালান কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দারাও পাচারকারীদের আনাগুনিতে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগে অনিয়মিতভাবে স্বর্ণ যেত, এখন বৈধ ট্রাক ও পাসপোর্টধারী যাত্রীদের মাধ্যমেও স্বর্ণ পাচার হচ্ছে, যেখানে দুই দেশের চালকেরাও জড়িত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর নজরদারি না থাকার সুযোগ নিচ্ছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। স্বর্ণ পাচারে টালমাটালে রয়েছে সীমান্ত এলাকাগুলো।
যশোরের মানবাধিকার সংগঠন রাইটস’র নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিকের মতে, প্রায় সময়ই দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে যাচ্ছে স্বর্ণ, আর এর বিনিময়ে এপারে আসছে মাদকসহ অবৈধ পণ্যসামগ্রী। পাচারে যুক্ত মূল হোতারা ধরা না পড়ায় সীমান্ত অপরাধ বেড়েই চলছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর বিজিবি’র ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানান, দেশের সীমান্ত সুরক্ষায় আন্তরিকভাবে কাজ করছে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ ভারতে স্বর্ণ পাচার ও মাদকসহ অন্যান্য অবৈধ পণ্যসামগ্রী প্রায়ই জব্দ করা হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চোরাচালানে জড়িত মূল হোতাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান বিজিবি’র এই কর্মকর্তা।

























