১০:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চীনের আগ্রহ তিস্তায়

  • প্রকল্প যাচাইয়ে বাংলাদেশে আসছে চীনের বিশেষজ্ঞ দল
  • চীনের কাছে ঋণ চেয়েছে ঢাকা, বেইজিং প্রকল্পেও আগ্রহ
  • তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ৭৫ কোটি ডলার
  • ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ
  • চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার
  • প্রতি বছর দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি

রংপুর অঞ্চলের মানুষ তিস্তা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চায় সরকার। ভারত না চীন, কে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এ নিয়ে গত বছরের শুরুর দিকে টানাপড়েনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এই আলোচনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও পরবর্তীকালে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে তিস্তায় ভারতের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ হয়ে আসে। এর বিপরীতে তারা চীনের সঙ্গে আলোচনায় আশা দেখছে।
এদিকে, বাংলাদেশ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা নিতে আগ্রহী। এ জন্য ঢাকা চীনের কাছ থেকে ঋণ চেয়েছে, এবং বেইজিংও প্রকল্পটিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চীনের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিনে তিস্তা প্রকল্প যাচাই করতে বাংলাদেশে আসবে। গত সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়ামের সঙ্গে আলোচনায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এ তথ্য জানিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। চীনের পক্ষ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, এ প্রকল্পের বিষয়ে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে কাজ করছে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর এবং চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে হাসপাতাল নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্পের হালনাগাদ পরিস্থিতিও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক সুশাসন উদ্যোগে (জিজিআই) বাংলাদেশকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জুলাই অভ্যুথানের পর চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য ৮০ কোটি ডলারের ওপরে পৌঁছেছে, যা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের পর অন্তর্বর্তী সরকার তিস্তা প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে। মে মাসে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি প্রেরণ করে এবং জুলাইয়ে ইআরডির মাধ্যমে চীনা দূতাবাসকে ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন পাঠানো হয়। তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৫৫ কোটি ডলার চীনের ঋণ থেকে আসবে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালে শুরু হয়ে ২০২৯ সালে শেষ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রমতে, ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রতি বছরই পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যেতেন। তবে প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রথম সফর হিসেবে ভারতকেই বেছে নিতেন তারা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীনেই যাচ্ছেন। সফর সম্পর্কে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে সফর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নানা কারণে চীন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। জানা গেছে, সফরে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট স্বীকৃতি দেয় চীন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন অনেক আগে থেকেই মধ্যস্থতা করে আসছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে চীন দূতিয়ালি করলেও এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বিশ্বের মধ্যে চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। চীন থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। বিপরীতে চীনে বাংলাদেশ রপ্তানি করে থাকে মাত্র ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। চীনা বাজারে বাংলাদেশ ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। এরপরও চীনে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বাড়ছে না। সে কারণে বাণিজ্য ভারসাম্যও রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করেছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে। বিভিন্ন প্রকল্পে সুদহার বিভিন্ন রকম। এ হার কমাতে চায় বাংলাদেশ। এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আছে। বিনিয়োগ মূলত ঋণ আকারে। তার মধ্যে কিছু প্রকল্প চলমান। এ ছাড়া আরও অর্থনৈতিক আলোচনা আছে যেমন আমরা ঋণের শর্তাদি নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে রয়েছে সুদহার কমানো বা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা সমঝোতা স্মারক রয়েছে। সেই সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরে এ সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা দিতে আগ্রহী চীন।
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্যা হিস্যা নিয়ে গত ৫৩ বছরে সমাধানে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। বারবার তিস্তায় আশা দেওয়ার পরও বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতিতে তিস্তার সমাধানে বিকল্প উপায় বের করে বাংলাদেশ। তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ মহাপ্রকল্প হাতে নেয়। তারই অংশ হিসেবে চীনের ঋণ নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিশদ সমীক্ষা শুরু করে ঢাকা-বেইজিং। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করা হয় প্রথমে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি দিয়ে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ এবং ২০২০ থেকে ২০২২ সাল এবং সর্বশেষ গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীন সরকারে সঙ্গে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি চুক্তি অনুযায়ী কাজ করে চীন। চুক্তি অনুযায়ী গত বছর জানুয়ারিতে সম্পন্ন হওয়ার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু নির্বাচনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, তিস্তা প্রকল্পের কাজ একা চীন নয়, ভারতকেও যুক্ত করা হবে। এর মধ্যে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশটির নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে মে মাসে শেখ হাসিনা দুদিনের সফরে দিল্লি যান। এদিকে তার আগেই শেখ হাসিনার চীনের সফর নির্ধারিত হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। ফলে দিল্লি সফরে তিস্তা বিষয়ে আলোচনা হয় মোদি-হাসিনার মধ্যে। তিস্তা প্রকল্পে চীনের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রবল আপত্তি আসে ভারতের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলা হয়। তবে সেই সফরে তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও চীনকে যে যুক্ত রাখা হবে না এমন ইঙ্গিত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরই ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকে। ফলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে শেখ হাসিনার চীন সফরের আগেই এক ধরনের টানাপড়েন দেখা দেয়। একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ আবার চীনের চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে চাপ দুইয়ে মিলে সরকার তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকেই সরে আসে। এরপর জুনের প্রথম সপ্তাহে চীন সফরেও তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা তেমন একটা এগোয়নি। শেখ হাসিনার চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসার পর চীনের পক্ষ থেকে যে উষ্ণতম সম্পর্কের আভাস পাওয়া গিয়েছিল এবং চীনের কাছ থেকে একটা বড় অঙ্কের ঋণের আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু চীন সফরে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। তার মধ্যে শেখ হাসিনা নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগে সফর শেষ করে দেশে ফেরেন। সেই সময়ই বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও দুই দেশের পক্ষ থেকে ব্যাপারে কূটনৈতিক শিষ্টাচার পালন করা হয়। এর মধ্যে চীনের সফরের মাত্র দুই মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হয়। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হতে থাকে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

কাবা শরীফ চত্বরে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা এক ব্যক্তির

চীনের আগ্রহ তিস্তায়

আপডেট সময় : ০৭:২৯:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রকল্প যাচাইয়ে বাংলাদেশে আসছে চীনের বিশেষজ্ঞ দল
  • চীনের কাছে ঋণ চেয়েছে ঢাকা, বেইজিং প্রকল্পেও আগ্রহ
  • তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ৭৫ কোটি ডলার
  • ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ
  • চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার
  • প্রতি বছর দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি

রংপুর অঞ্চলের মানুষ তিস্তা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চায় সরকার। ভারত না চীন, কে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এ নিয়ে গত বছরের শুরুর দিকে টানাপড়েনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এই আলোচনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও পরবর্তীকালে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে তিস্তায় ভারতের সম্ভাবনার বিষয়টি ক্ষীণ হয়ে আসে। এর বিপরীতে তারা চীনের সঙ্গে আলোচনায় আশা দেখছে।
এদিকে, বাংলাদেশ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা নিতে আগ্রহী। এ জন্য ঢাকা চীনের কাছ থেকে ঋণ চেয়েছে, এবং বেইজিংও প্রকল্পটিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চীনের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিনে তিস্তা প্রকল্প যাচাই করতে বাংলাদেশে আসবে। গত সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়ামের সঙ্গে আলোচনায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এ তথ্য জানিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। চীনের পক্ষ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, এ প্রকল্পের বিষয়ে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে কাজ করছে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর এবং চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে হাসপাতাল নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্পের হালনাগাদ পরিস্থিতিও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক সুশাসন উদ্যোগে (জিজিআই) বাংলাদেশকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জুলাই অভ্যুথানের পর চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য ৮০ কোটি ডলারের ওপরে পৌঁছেছে, যা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের পর অন্তর্বর্তী সরকার তিস্তা প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে। মে মাসে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি প্রেরণ করে এবং জুলাইয়ে ইআরডির মাধ্যমে চীনা দূতাবাসকে ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন পাঠানো হয়। তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৫৫ কোটি ডলার চীনের ঋণ থেকে আসবে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালে শুরু হয়ে ২০২৯ সালে শেষ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রমতে, ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রতি বছরই পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যেতেন। তবে প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রথম সফর হিসেবে ভারতকেই বেছে নিতেন তারা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীনেই যাচ্ছেন। সফর সম্পর্কে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে সফর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নানা কারণে চীন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। জানা গেছে, সফরে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট স্বীকৃতি দেয় চীন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন অনেক আগে থেকেই মধ্যস্থতা করে আসছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে চীন দূতিয়ালি করলেও এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বিশ্বের মধ্যে চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। চীন থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। বিপরীতে চীনে বাংলাদেশ রপ্তানি করে থাকে মাত্র ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। চীনা বাজারে বাংলাদেশ ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। এরপরও চীনে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বাড়ছে না। সে কারণে বাণিজ্য ভারসাম্যও রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করেছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে। বিভিন্ন প্রকল্পে সুদহার বিভিন্ন রকম। এ হার কমাতে চায় বাংলাদেশ। এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আছে। বিনিয়োগ মূলত ঋণ আকারে। তার মধ্যে কিছু প্রকল্প চলমান। এ ছাড়া আরও অর্থনৈতিক আলোচনা আছে যেমন আমরা ঋণের শর্তাদি নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে রয়েছে সুদহার কমানো বা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা সমঝোতা স্মারক রয়েছে। সেই সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরে এ সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা দিতে আগ্রহী চীন।
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্যা হিস্যা নিয়ে গত ৫৩ বছরে সমাধানে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। বারবার তিস্তায় আশা দেওয়ার পরও বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতিতে তিস্তার সমাধানে বিকল্প উপায় বের করে বাংলাদেশ। তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ মহাপ্রকল্প হাতে নেয়। তারই অংশ হিসেবে চীনের ঋণ নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিশদ সমীক্ষা শুরু করে ঢাকা-বেইজিং। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করা হয় প্রথমে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি দিয়ে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ এবং ২০২০ থেকে ২০২২ সাল এবং সর্বশেষ গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীন সরকারে সঙ্গে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি চুক্তি অনুযায়ী কাজ করে চীন। চুক্তি অনুযায়ী গত বছর জানুয়ারিতে সম্পন্ন হওয়ার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু নির্বাচনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, তিস্তা প্রকল্পের কাজ একা চীন নয়, ভারতকেও যুক্ত করা হবে। এর মধ্যে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশটির নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে মে মাসে শেখ হাসিনা দুদিনের সফরে দিল্লি যান। এদিকে তার আগেই শেখ হাসিনার চীনের সফর নির্ধারিত হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। ফলে দিল্লি সফরে তিস্তা বিষয়ে আলোচনা হয় মোদি-হাসিনার মধ্যে। তিস্তা প্রকল্পে চীনের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে প্রবল আপত্তি আসে ভারতের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলা হয়। তবে সেই সফরে তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও চীনকে যে যুক্ত রাখা হবে না এমন ইঙ্গিত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরই ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকে। ফলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে শেখ হাসিনার চীন সফরের আগেই এক ধরনের টানাপড়েন দেখা দেয়। একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ আবার চীনের চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে চাপ দুইয়ে মিলে সরকার তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকেই সরে আসে। এরপর জুনের প্রথম সপ্তাহে চীন সফরেও তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা তেমন একটা এগোয়নি। শেখ হাসিনার চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসার পর চীনের পক্ষ থেকে যে উষ্ণতম সম্পর্কের আভাস পাওয়া গিয়েছিল এবং চীনের কাছ থেকে একটা বড় অঙ্কের ঋণের আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু চীন সফরে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। তার মধ্যে শেখ হাসিনা নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগে সফর শেষ করে দেশে ফেরেন। সেই সময়ই বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও দুই দেশের পক্ষ থেকে ব্যাপারে কূটনৈতিক শিষ্টাচার পালন করা হয়। এর মধ্যে চীনের সফরের মাত্র দুই মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হয়। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হতে থাকে।