এক সময় উত্তরাঞ্চলের কৃষিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মহিষ। হালচাষ, পণ্য পরিবহন কিংবা দুধ উৎপাদনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ছিল এর অপরিসীম গুরুত্ব। শুধু তাই নয়, মইশালকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল নারীর আবেগময় ভাওয়াইয়া গান— “ধিকো ধিকো আরে ও মইশাল ধিকো তোমার হিয়া, কোন পরাণে যাইবেন মইশাল আমাকো ছাড়িয়ে…”— যা একসময়ে ছিল উত্তরাঞ্চলের জীবনচিত্রের অংশ।
কালের পরিক্রমায় সেই মহিষ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা, আধুনিক চাষাবাদ, প্রতিকূল পরিবেশ, খাদ্য সংকট, কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের অভাব এবং অন্যান্য গবাদিপশুর তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় মহিষের বংশবিস্তার আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
রংপুর প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ বছর আগে রংপুর বিভাগে মহিষের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লক্ষাধিক। বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৫ হাজার ৩৪৮টিতে। বর্তমানে রংপুর বিভাগে মোট গবাদিপশুর সংখ্যা ১ কোটি ৫ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯০৪টি। এর মধ্যে গরু ৩৯ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬৫৭টি, ছাগল ৫৮ লক্ষ ৩০ হাজার ৭২০টি, ভেড়া ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার ৮৭৯টি, মহিষ ৩৫ হাজার ৩৪৮টি এবং অন্যান্য পশু ৪১ হাজার ৩০৪টি।
বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহিষ রয়েছে পঞ্চগড় ও গাইবান্ধা জেলায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুরে মহিষ আছে ২,২৭৯টি, গাইবান্ধায় ৭,২০৮টি, কুড়িগ্রামে ৫,৫৪৩টি, লালমনিরহাটে ২,৬০৮টি, নীলফামারীতে ২,৬২৫টি, দিনাজপুরে ৪,০২৭টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪,০২৮টি এবং পঞ্চগড়ে ৭,০৩০টি।
রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন,
“উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে এখন আর কেউ মহিষ দিয়ে হালচাষ বা পণ্য পরিবহন করে না। যান্ত্রিক বাহনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গরু-মহিষের গাড়ির প্রচলন প্রায় উঠে গেছে। তাছাড়া মহিষের খাবারের চাহিদা বেশি হওয়ায় অনেকে পালন করতে পারেন না। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত প্রভাবেও মহিষের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, রংপুর অঞ্চলে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র না থাকায় মহিষের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মাত্র একটি মহিষ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায়, এবং একমাত্র সরকারি মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামারটি অবস্থিত বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলায়।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে রংপুরের পীরগাছায় দেশে দ্বিতীয় কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
তবুও, গ্রামীণ জনপদের কোথাও কোথাও এখনো কয়েকজন গৃহস্থ ঐতিহ্য ধরে রাখতে মহিষ পালন করছেন— উত্তরবঙ্গের কৃষিসংস্কৃতির শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
এমআর/সবা























