০৩:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাহাড়ি পথের পরিশ্রম—জীবিকার টানে সবুজ শাক সংগ্রহে দুই নারী

রাঙ্গামাটির রাজস্থলীর দুর্গম পাহাড়ি জনপদে জীবনযাত্রা যেমন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়া, তেমনি সেখানে টিকে থাকার সংগ্রামও নিত্যদিনের বাস্তবতা। বন-জঙ্গল, পাথুরে ঢাল, সরু পথ আর অনিশ্চিত আবহাওয়ার মাঝেও পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের চিত্র যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এই কঠোর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিলেন দুই পাহাড়ি নারী—কাঁধে ঝুলি, হাতে খসখসে ছাপ, চোখে দৃঢ়তা আর জীবনের প্রতি অদম্য বিশ্বাস।

সকালের কোমল আলো যখন পাহাড়ের চূড়ায় পড়তে শুরু করেছে, তখনই সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে আসছিলেন তারা। ভোর থেকে জঙ্গল আর চাষের জমিতে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা তাজা সবুজ শাকসবজি তারা বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের রোজগারের আশায়। ছবিতে দেখা যায়, পাহাড়ের এক বাঁকে দাঁড়িয়ে এক নারী বড় ডালি থেকে শাক-সবজি ঝুড়িতে ভরছেন, আর অন্য নারী সেই ভারী বোঝাটি কাঁধে তুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চারদিকে সবুজে মোড়া পাহাড়ি নিসর্গ—পাখির ডাক, হালকা বাতাস আর দূরের ঝরনার মৃদু শব্দ যেন তাদের কঠোর শ্রমের মাঝে প্রশান্তির আভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তাদের পোশাকে কাজের দাগ, রোদে পোড়া মুখ, হাতে দিনের পর দিনের পরিশ্রমের চিহ্ন—তবু তাদের চোখে ক্লান্তির চেয়ে জীবিকার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ের ঝিলিক আরও স্পষ্ট। পাহাড়ের জীবন যেমন কঠিন, তেমনি পাহাড়ি নারীদের মনোবলও অটুট—প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন তার প্রমাণ।

স্থানীয় এক পাহাড়ি নারী জানালেন, “আমরা পাহাড়ের মানুষ। ভোরের আগে জঙ্গল বা মাঠে যাই, সারাদিন কাজ করি। যা পাই, তাই নিয়ে বাজারে যাই। আমাদের সংসার চলে এই পরিশ্রমের ওপরই। শাক-পাতা না থাকলে কখনো কাঠ, কখনো বুনো ফল—যা পাওয়া যায়, তা-ই রোজগার।”

এক কৃষক বলেন, “বর্ষায় শাকসবজি জন্মানো কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় পাহাড়ধসের ভয় থাকে। তারপরও আমরা যা পাই সংগ্রহ করি, কারণ বাজারে এগুলো বিক্রি করাই আমাদের পরিবারের আয়। আমরা কষ্ট করি বলে শহরের মানুষ তাজা সবজি পায়।”

স্থানীয় চাষিরা জানান, এখন পাহাড়ে মৌসুমি শাক যেমন—চুকাই, হিংগা, মিজু শাক, কচুশাক, বুনো করল্লা—অনেকটাই সহজলভ্য। তবে এগুলো সংগ্রহে শারীরিক পরিশ্রম এবং সময় দুটিই বেশি লাগে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা, ভারী ঝুড়ি বহন করার কষ্ট—সব মিলিয়ে নারীরা দৈনিক প্রায় ৮–১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন। তবু তাদের মুখে অভিযোগ নেই; বরং রয়েছে জীবনের প্রতি অদম্য টান।

এই দুই নারীর গল্প কেবল শ্রমের ছবি নয়—এটি পাহাড়ি নারীর স্থিতিস্থাপকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে বাঁচার সংগ্রামের জীবন্ত উদাহরণ। পাহাড়ের শ্যামলতার মাঝেও তাদের পরিশ্রম যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রকৃতি যেমন দেয় সৌন্দর্য, তেমনি প্রতিদানও দাবি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে—এটাই এখানে মানুষের বাস্তবতা।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়ি নারীরা স্থানীয় কৃষিজ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখলেও তাদের স্বীকৃতি কম। বাজারে একটি ঝুড়ি শাক বিক্রি করে তারা কখনো ২০০–৩০০ টাকা পান, আবার কখনো আরও কম। তবু এই সামান্য রোজগার দিয়েই চলে তাদের সংসার, সন্তানের পড়াশোনা, চিকিৎসা এবং মৌসুমভিত্তিক চাষের প্রস্তুতি।

সবুজ পাহাড়, নীরব প্রকৃতি আর দুই নারীর দৃঢ়তায় ভরা এই দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে একটি বড় সত্য—এই শ্রমই পাহাড়ি জনজীবনের প্রাণ, এই পরিশ্রমই তাদের বাঁচার শক্তি। আর পাহাড়ের এই নীরব, অদেখা সংগ্রামী গল্পগুলোই সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যা জানিয়ে দেয়—সংগ্রামই জীবনের স্বাভাবিক পথ, আর পরিশ্রমই মানুষের প্রকৃত পরিচয়।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

নোয়াখালীতে ৬ আসনে ৬২ প্রাথীর মনোনয়নপত্র দাখিল

পাহাড়ি পথের পরিশ্রম—জীবিকার টানে সবুজ শাক সংগ্রহে দুই নারী

আপডেট সময় : ১২:০০:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

রাঙ্গামাটির রাজস্থলীর দুর্গম পাহাড়ি জনপদে জীবনযাত্রা যেমন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়া, তেমনি সেখানে টিকে থাকার সংগ্রামও নিত্যদিনের বাস্তবতা। বন-জঙ্গল, পাথুরে ঢাল, সরু পথ আর অনিশ্চিত আবহাওয়ার মাঝেও পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের চিত্র যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এই কঠোর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিলেন দুই পাহাড়ি নারী—কাঁধে ঝুলি, হাতে খসখসে ছাপ, চোখে দৃঢ়তা আর জীবনের প্রতি অদম্য বিশ্বাস।

সকালের কোমল আলো যখন পাহাড়ের চূড়ায় পড়তে শুরু করেছে, তখনই সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে আসছিলেন তারা। ভোর থেকে জঙ্গল আর চাষের জমিতে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা তাজা সবুজ শাকসবজি তারা বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের রোজগারের আশায়। ছবিতে দেখা যায়, পাহাড়ের এক বাঁকে দাঁড়িয়ে এক নারী বড় ডালি থেকে শাক-সবজি ঝুড়িতে ভরছেন, আর অন্য নারী সেই ভারী বোঝাটি কাঁধে তুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চারদিকে সবুজে মোড়া পাহাড়ি নিসর্গ—পাখির ডাক, হালকা বাতাস আর দূরের ঝরনার মৃদু শব্দ যেন তাদের কঠোর শ্রমের মাঝে প্রশান্তির আভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তাদের পোশাকে কাজের দাগ, রোদে পোড়া মুখ, হাতে দিনের পর দিনের পরিশ্রমের চিহ্ন—তবু তাদের চোখে ক্লান্তির চেয়ে জীবিকার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ের ঝিলিক আরও স্পষ্ট। পাহাড়ের জীবন যেমন কঠিন, তেমনি পাহাড়ি নারীদের মনোবলও অটুট—প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন তার প্রমাণ।

স্থানীয় এক পাহাড়ি নারী জানালেন, “আমরা পাহাড়ের মানুষ। ভোরের আগে জঙ্গল বা মাঠে যাই, সারাদিন কাজ করি। যা পাই, তাই নিয়ে বাজারে যাই। আমাদের সংসার চলে এই পরিশ্রমের ওপরই। শাক-পাতা না থাকলে কখনো কাঠ, কখনো বুনো ফল—যা পাওয়া যায়, তা-ই রোজগার।”

এক কৃষক বলেন, “বর্ষায় শাকসবজি জন্মানো কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় পাহাড়ধসের ভয় থাকে। তারপরও আমরা যা পাই সংগ্রহ করি, কারণ বাজারে এগুলো বিক্রি করাই আমাদের পরিবারের আয়। আমরা কষ্ট করি বলে শহরের মানুষ তাজা সবজি পায়।”

স্থানীয় চাষিরা জানান, এখন পাহাড়ে মৌসুমি শাক যেমন—চুকাই, হিংগা, মিজু শাক, কচুশাক, বুনো করল্লা—অনেকটাই সহজলভ্য। তবে এগুলো সংগ্রহে শারীরিক পরিশ্রম এবং সময় দুটিই বেশি লাগে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা, ভারী ঝুড়ি বহন করার কষ্ট—সব মিলিয়ে নারীরা দৈনিক প্রায় ৮–১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন। তবু তাদের মুখে অভিযোগ নেই; বরং রয়েছে জীবনের প্রতি অদম্য টান।

এই দুই নারীর গল্প কেবল শ্রমের ছবি নয়—এটি পাহাড়ি নারীর স্থিতিস্থাপকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে বাঁচার সংগ্রামের জীবন্ত উদাহরণ। পাহাড়ের শ্যামলতার মাঝেও তাদের পরিশ্রম যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রকৃতি যেমন দেয় সৌন্দর্য, তেমনি প্রতিদানও দাবি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে—এটাই এখানে মানুষের বাস্তবতা।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়ি নারীরা স্থানীয় কৃষিজ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখলেও তাদের স্বীকৃতি কম। বাজারে একটি ঝুড়ি শাক বিক্রি করে তারা কখনো ২০০–৩০০ টাকা পান, আবার কখনো আরও কম। তবু এই সামান্য রোজগার দিয়েই চলে তাদের সংসার, সন্তানের পড়াশোনা, চিকিৎসা এবং মৌসুমভিত্তিক চাষের প্রস্তুতি।

সবুজ পাহাড়, নীরব প্রকৃতি আর দুই নারীর দৃঢ়তায় ভরা এই দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে একটি বড় সত্য—এই শ্রমই পাহাড়ি জনজীবনের প্রাণ, এই পরিশ্রমই তাদের বাঁচার শক্তি। আর পাহাড়ের এই নীরব, অদেখা সংগ্রামী গল্পগুলোই সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যা জানিয়ে দেয়—সংগ্রামই জীবনের স্বাভাবিক পথ, আর পরিশ্রমই মানুষের প্রকৃত পরিচয়।

এমআর/সবা