১১:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি

  • সাশ্রয়ীমূল্যে স্মার্টফোন বাজারে চীনের রাজত্ব
  • ইলেকট্রিক গাড়িতে গতি পাচ্ছে দ্রুত
  • টেলিকম খাতে চীনের প্রভাব, বিনিয়োগে নতুন গতি
  • বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে চীন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান দুই দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনা সহায়তায় ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে চীনা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাজ করছে বিশেষ করে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড প্রযুক্তিতে। সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ উদ্যোগের সঙ্গে চীনা প্রযুক্তির মেলবন্ধন নতুন বাজার ও সেবা খাতের জন্ম দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ই-কমার্স, মোবাইল পেমেন্ট, এআইনির্ভর সাপ্লাই চেইন এবং ডিজিটাল কৃষি বাজার এখন দ্রুত প্রসার পাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে চীনা কোম্পানিগুলো টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক যানবাহন (ইভি) খাতে চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দেশের ডিজিটাল পরিকাঠামো নতুনভাবে গড়ে তুলছে। ফলে বাংলাদেশকে একটি বুদ্ধিমান ও প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে প্রায় ৩০টির বেশি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেজা সম্প্রতি চীনের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চায়না লেসো গ্রুপের কাছে ১২ দশমিক ৫ একর জমি হস্তান্তর করেছে। চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২৪ সালের শেষে প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে। বেজার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চীনা মালিকানাধীন বা যৌথভাবে পরিচালিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এসবের মধ্যে রয়েছে মেশিনারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, তুলা, রাসায়নিক ও বিভিন্ন কাঁচামাল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের জন্য চীন শুধু একটি রপ্তানি গন্তব্য নয়, বরং প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎস। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরও শক্ত ও কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিচ্ছে। রোচি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও ইলেকট্রনিক্স খাতে চীনা বিনিয়োগ এখন আরও বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে আমরা আশাবাদী যে এসব খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিকাশে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্পে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। সুলভমূল্যে এসব উপকরণ সরবরাহের কারণে আমরা শুধু নিজস্ব বাজারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানির উৎস। পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তিপণ্য, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও ভোক্তাপণ্যসহ নানা খাতেই চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ব্যাপক। যদিও রপ্তানি খাত এখনো তুলনামূলক সীমিত। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য, পাটজাত সামগ্রী ও ওষুধ খাতে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করে চীন, যা বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চীনা বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করছে। হুয়াওয়ে, শাওমি, অপো, ভিভোসহ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আজ একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। চীনের প্রযুক্তি, বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিকে শুধু লেখালেখি, ছবি তৈরি বা চ্যাটবটের মধ্যেই সীমাবদ্ধভাবে কল্পনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর ও অনুসরণযোগ্য মডেল হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এআই স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা সায়েন্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। স্কুলপর্যায় থেকেই প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে দেশে একটি শক্তিশালী এআই ট্যালেন্টপুল গড়ে তুলতে হবে, যারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলোর (গ্রামীণফোন বাদে) প্রায় সবগুলোই চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এছাড়া সরকারি নিরাপত্তা অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং ডেটা সেন্টারে চীনা কোম্পানির প্রযুক্তি রয়েছে। এখানে ভূ-রাজনৈতিক একটি বাস্তবতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে বর্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি গ্রহণে তুলনামূলক উন্মুক্ত বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারেও চীনা ব্র্যান্ডের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অপো, টেকনো, রিয়েলমি, ভিভো, শাওমি এখন দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। সাশ্রয়ীমূল্য, আকর্ষণীয় ডিজাইন, ভালো মানের ক্যামেরা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি- এই চার বৈশিষ্ট্য চীনা ব্র্যান্ডগুলো জনপ্রিয় করেছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি

আপডেট সময় : ০৭:৩৫:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
  • সাশ্রয়ীমূল্যে স্মার্টফোন বাজারে চীনের রাজত্ব
  • ইলেকট্রিক গাড়িতে গতি পাচ্ছে দ্রুত
  • টেলিকম খাতে চীনের প্রভাব, বিনিয়োগে নতুন গতি
  • বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে চীন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান দুই দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনা সহায়তায় ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে চীনা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাজ করছে বিশেষ করে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড প্রযুক্তিতে। সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ উদ্যোগের সঙ্গে চীনা প্রযুক্তির মেলবন্ধন নতুন বাজার ও সেবা খাতের জন্ম দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ই-কমার্স, মোবাইল পেমেন্ট, এআইনির্ভর সাপ্লাই চেইন এবং ডিজিটাল কৃষি বাজার এখন দ্রুত প্রসার পাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে চীনা কোম্পানিগুলো টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক যানবাহন (ইভি) খাতে চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দেশের ডিজিটাল পরিকাঠামো নতুনভাবে গড়ে তুলছে। ফলে বাংলাদেশকে একটি বুদ্ধিমান ও প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে প্রায় ৩০টির বেশি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেজা সম্প্রতি চীনের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চায়না লেসো গ্রুপের কাছে ১২ দশমিক ৫ একর জমি হস্তান্তর করেছে। চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২৪ সালের শেষে প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে। বেজার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চীনা মালিকানাধীন বা যৌথভাবে পরিচালিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এসবের মধ্যে রয়েছে মেশিনারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, তুলা, রাসায়নিক ও বিভিন্ন কাঁচামাল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের জন্য চীন শুধু একটি রপ্তানি গন্তব্য নয়, বরং প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎস। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরও শক্ত ও কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিচ্ছে। রোচি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও ইলেকট্রনিক্স খাতে চীনা বিনিয়োগ এখন আরও বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে আমরা আশাবাদী যে এসব খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিকাশে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্পে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। সুলভমূল্যে এসব উপকরণ সরবরাহের কারণে আমরা শুধু নিজস্ব বাজারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানির উৎস। পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তিপণ্য, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও ভোক্তাপণ্যসহ নানা খাতেই চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ব্যাপক। যদিও রপ্তানি খাত এখনো তুলনামূলক সীমিত। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য, পাটজাত সামগ্রী ও ওষুধ খাতে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করে চীন, যা বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চীনা বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করছে। হুয়াওয়ে, শাওমি, অপো, ভিভোসহ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আজ একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। চীনের প্রযুক্তি, বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিকে শুধু লেখালেখি, ছবি তৈরি বা চ্যাটবটের মধ্যেই সীমাবদ্ধভাবে কল্পনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর ও অনুসরণযোগ্য মডেল হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এআই স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা সায়েন্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। স্কুলপর্যায় থেকেই প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে দেশে একটি শক্তিশালী এআই ট্যালেন্টপুল গড়ে তুলতে হবে, যারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলোর (গ্রামীণফোন বাদে) প্রায় সবগুলোই চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এছাড়া সরকারি নিরাপত্তা অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং ডেটা সেন্টারে চীনা কোম্পানির প্রযুক্তি রয়েছে। এখানে ভূ-রাজনৈতিক একটি বাস্তবতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে বর্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি গ্রহণে তুলনামূলক উন্মুক্ত বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারেও চীনা ব্র্যান্ডের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অপো, টেকনো, রিয়েলমি, ভিভো, শাওমি এখন দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। সাশ্রয়ীমূল্য, আকর্ষণীয় ডিজাইন, ভালো মানের ক্যামেরা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি- এই চার বৈশিষ্ট্য চীনা ব্র্যান্ডগুলো জনপ্রিয় করেছে।