১১:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়ায় সিলেটে ঘরে ঘরে অসুস্থতা, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে

সিলেটে শীতের হাওয়া নামতেই ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। শহর থেকে গ্রাম—সবখানে সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও হাঁপানিতে ভুগছেন শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও দীর্ঘদিনের অসুস্থ মানুষ। প্রতিদিনই হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় গত এক সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এটি শুধু মৌসুমি অসুস্থতা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে—শিশুদের শ্বাসকষ্ট, ভাইরাল জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী ভর্তির সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। দ্রুত তাপমাত্রা হ্রাস, ভোর ও রাতে ঠান্ডা বাতাস এবং ধুলাবালির কারণে এলার্জিজনিত সমস্যাও বাড়ছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য—ঘরে ঘরে এখন অসুস্থ কেউ না কেউ আছেন। আম্বরখানা বড়বাজারের সাবিনা আক্তার বলেন, ‘আমার তিন বছরের ছেলে দু’দিন ধরে জ্বর–সর্দিতে কাহিল। শুধু আমাদের বাসায় নয়, আশপাশের প্রায় সব বাচ্চাই এখন অসুস্থ।’ গোয়াইপাড়ার গৃহিণী ফাতেমা বেগম শিউলি জানান, ‘চার দিন ধরে মাথাব্যথা–গলাব্যথা–জ্বরে কাবু হয়ে আছি, কোনো ওষুধেই আরাম মিলছে না।’

শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত প্রবীণদের অবস্থাও উদ্বেগজনক। বাগবাড়ির নোমান মিয়া বলেন, ‘বাবার শ্বাসকষ্ট কমছেই না। হাসপাতালে নিলে কমে, বাসায় ফিরলে আবার বেড়ে যায়।’

শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘শিশু, প্রবীণ ও দুর্বল রোগীদের অবস্থাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন, অনেককেই ভর্তি করতে হচ্ছে। তাই উষ্ণ পোশাক, বিশ্রাম আর দ্রুত চিকিৎসা এখন অত্যন্ত জরুরি।’

এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ সহজেই আক্রমণ করছে। শিশু রোগীর সংখ্যা গত কয়েক দিনে অনেক বেড়েছে।’

সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, ‘হাসপাতালে রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও পূর্বের অসুস্থতায় ভোগা মানুষ বেশি ঝুঁকিতে আছেন। সময়মতো সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’

নগরীর ফার্মেসিগুলোতেও ঠান্ডাজনিত ওষুধ, কাশির সিরাপ ও ইনহেলারের চাহিদা বেড়েছে। কিছু ব্র্যান্ডের ইনহেলারে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা গেছে সিলেটের চা-বাগান এলাকাগুলোতে। শ্রমিকেরা জানান—বাগান কলোনিগুলোতে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই, ঘরগুলোতে বাতাস ঢুকছে, ফলে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের অবস্থাই সবচেয়ে বেশি নাজুক।

সব মিলিয়ে সিলেটে শীত কেবল আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়—একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রূপ নিয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, উষ্ণ পোশাক পরা, ঘর–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, শিশু ও প্রবীণদের বাড়তি যত্ন এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া—এই মুহূর্তে সবার জন্য অপরিহার্য। সতর্কতা ও সময়মতো চিকিৎসা নিলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এমআর/সবা

জনপ্রিয় সংবাদ

মেঘনায় দুই লঞ্চের সংঘর্ষে ৮ জন নিহত

জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়ায় সিলেটে ঘরে ঘরে অসুস্থতা, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে

আপডেট সময় : ০৪:১৬:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

সিলেটে শীতের হাওয়া নামতেই ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। শহর থেকে গ্রাম—সবখানে সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও হাঁপানিতে ভুগছেন শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও দীর্ঘদিনের অসুস্থ মানুষ। প্রতিদিনই হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় গত এক সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এটি শুধু মৌসুমি অসুস্থতা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে—শিশুদের শ্বাসকষ্ট, ভাইরাল জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী ভর্তির সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। দ্রুত তাপমাত্রা হ্রাস, ভোর ও রাতে ঠান্ডা বাতাস এবং ধুলাবালির কারণে এলার্জিজনিত সমস্যাও বাড়ছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য—ঘরে ঘরে এখন অসুস্থ কেউ না কেউ আছেন। আম্বরখানা বড়বাজারের সাবিনা আক্তার বলেন, ‘আমার তিন বছরের ছেলে দু’দিন ধরে জ্বর–সর্দিতে কাহিল। শুধু আমাদের বাসায় নয়, আশপাশের প্রায় সব বাচ্চাই এখন অসুস্থ।’ গোয়াইপাড়ার গৃহিণী ফাতেমা বেগম শিউলি জানান, ‘চার দিন ধরে মাথাব্যথা–গলাব্যথা–জ্বরে কাবু হয়ে আছি, কোনো ওষুধেই আরাম মিলছে না।’

শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত প্রবীণদের অবস্থাও উদ্বেগজনক। বাগবাড়ির নোমান মিয়া বলেন, ‘বাবার শ্বাসকষ্ট কমছেই না। হাসপাতালে নিলে কমে, বাসায় ফিরলে আবার বেড়ে যায়।’

শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘শিশু, প্রবীণ ও দুর্বল রোগীদের অবস্থাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন, অনেককেই ভর্তি করতে হচ্ছে। তাই উষ্ণ পোশাক, বিশ্রাম আর দ্রুত চিকিৎসা এখন অত্যন্ত জরুরি।’

এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ সহজেই আক্রমণ করছে। শিশু রোগীর সংখ্যা গত কয়েক দিনে অনেক বেড়েছে।’

সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, ‘হাসপাতালে রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও পূর্বের অসুস্থতায় ভোগা মানুষ বেশি ঝুঁকিতে আছেন। সময়মতো সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’

নগরীর ফার্মেসিগুলোতেও ঠান্ডাজনিত ওষুধ, কাশির সিরাপ ও ইনহেলারের চাহিদা বেড়েছে। কিছু ব্র্যান্ডের ইনহেলারে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা গেছে সিলেটের চা-বাগান এলাকাগুলোতে। শ্রমিকেরা জানান—বাগান কলোনিগুলোতে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই, ঘরগুলোতে বাতাস ঢুকছে, ফলে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের অবস্থাই সবচেয়ে বেশি নাজুক।

সব মিলিয়ে সিলেটে শীত কেবল আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়—একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রূপ নিয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, উষ্ণ পোশাক পরা, ঘর–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, শিশু ও প্রবীণদের বাড়তি যত্ন এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া—এই মুহূর্তে সবার জন্য অপরিহার্য। সতর্কতা ও সময়মতো চিকিৎসা নিলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এমআর/সবা