সোহাগ রহমান, ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনজীবনে বিদ্যুতের ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে কুপিবাতি আর হারিকেন। নব্বই দশকেও গ্রামীণ
বাড়ি ঘরে কুপিবাতি আর হারিকেন ছাড়া আলোর চিন্তাই করা যেতো না। আজ বিদ্যুতের ছোঁয়ায় কুপিবাতি আর হারিকেনের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
উপজেলার ভান্ডাব ভয়টাপাড়া গ্রামের আইন উদ্দিন মাস্টার জানান, যুগ যুগ ধরে চলেছে গ্রামে-গঞ্জে কুপিবাতি আর হারিকেনের ব্যবহার। সন্ধ্যা হলেই
কুপিবাতি জ্বালিয়ে পড়ালেখা করতে বসতেন তিনি। কখনও কখনও হারিকেন জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতে হতো তাকে। রাতে রান্না ঘরে কুপিবাতি জ্বালিয়ে রান্না করতেন তার মা। কুপিবাতি কিংবা হারিকেনের আলোই তারা জীবন আলোকিত করতেন। তখন শুধুমাত্র শহরের মানুষেরা বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করতো। তিনি আরও জানান, প্রায় ২০ বছর হয় তাদের গ্রামে পল্লী বিদ্যুত লাইন নির্মাণ হয়। এ থেকে তারা বিদ্যুত সুবিধা ভোগ করছে। পল্লী বিদ্যুতের বদৌলতে তিনিসহ তাদের গ্রামের বাড়ি ঘরে বিদ্যুত সুবিধা ভোগ করছে মানুষ। বিদ্যুতের আলোতে অনায়াসে গ্রামের ছেলেমেয়েরা সুন্দর ভাবে পড়ালেখা করতে পারছে। যেখানে টিভি ফ্রিজের ব্যবহার চিন্তাই করা যেতো না, সেখানে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ঘরে টিভি, ফ্রিজসহ নানা ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করছে মানুষ।
ডাকাতিয়া গ্রামের পল্লী চিকিৎসক শাহজাহান সিরাজী বলেন, ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও গ্রামের গৃহিনীরা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে সন্ধ্যায় ঘরে আলো
জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। প্রযুক্তির বদৌলতে দেশ আধুনিকায়নের ফলে সমাজ পরিবর্তন হয়ে উঠেছে। কুপিবাতি কিংবা হারিকেন বিদ্যুতের আলোতে আজ হারিয়ে গেছে। গ্রামের অধিকাংশ ঘরেই এখন বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার কিংবা সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পরীক্ষার সময় আসলে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতাম। তখন হারিকেনের আলোতেই পড়াশুনা করতে হতো। যদিও হারিকেনে আলো কম পাওয়া যেতো, তবুও খুব কষ্ট করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতাম।
এখন গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুত চলে আসায় বিদ্যুতের আলোতেই শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে।
পুরুড়া গ্রামের প্রভাষক আশরাফুল ইসলাম জানান, গ্রামাঞ্চলে এখন কুপিবাতি কিংবা হারিকেনের ব্যবহার একটি বাড়িতেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এখন
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই পিডিবি কিংবা পল্লী বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। যেসব এলাকায় বিদ্যুত যায়নি অর্থাৎ একেবারেই দুর্গম এলাকা সেখানেও দেখা
যায়, সৌর বিদ্যুত রয়েছে। সৌর বিদ্যুতের দ্বারা টিভি, ফ্যান, বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার করছে। বিদ্যুত ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ জীবন সহজ হয়ে উঠছে। একটা
সময় শিক্ষার্থী কুপিবাতি কিংবা হারিকেনের আলোতে ঠিকমতো পড়াশুনা করতে পারতো না। এখন গ্রামের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষিকা জায়েদা আক্তার বলেন, আগে প্রতিদিন সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশুনা করতাম। পড়াশুনা শেষ করে ঘুমানোর আগে হারিকেনের আলো কমিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন কুপিবাতি ছিল কয়েক প্রকার। একনলা, দুই নলা, একতাক, দুই তাকের পিতল ও সিলভারের। তবে সিলভার, টিন এবং মাটির তৈরি বাতির ব্যবহার ছিল খুব বেশি। এখন বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগায় জীবন যাত্রার মানই পাল্টে গেছে।
কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের ছোঁয়া যখন গ্রামীণ জীবনে লাগেনি তখন কুপিবাতি কিংবা হারিকেনই ছিল একমাত্র ভরসা।
রাতে পড়াশুনা, গৃহিনীদের রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া করতে হারিকেন কিংবা কুপিবাতির আলোতেই সারতে হতো। এখন কালের বিবর্তে হারিয়েছে পরিবেশ
বান্ধব কুপিবাতি কিংবা হারিকেনের ব্যবহার। ভবিষ্যত প্রজন্ম হারিকেনের ব্যবহার দেখার আর সুযোগ নেই। এক সময় গ্রামীণ জীবন যাত্রায় হারিকেন আর
কুপিবাতি ছিল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামীণ বাড়ি ঘরে আর নয় ভবিষ্যতে হয়তো জাদুঘর কিংবা কোনো সংগ্রহশালায় আগামী প্রজন্ম এটি দেখতে
পাবে।


























