আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আসনে তারই সহোদর ভাই-বোন নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। ভোটের মাঠে তাদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে চলছে আলোচনার ঝড়। কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনে টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যুর পর নৌকা প্রতীক নিয়ে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের নেতৃত্বে আসেন তারই ছোট বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী ও উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এ আসনটিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর নির্বাচনী এলাকাসহ এই অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে যতবারই তিনি প্রার্থী হয়েছেন, এখানকার মানুষ তাঁকে ততবারই আপনজন মনে করে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর পর এ আসনের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। এবারের নির্বাচনেও তাঁর উপরে আস্থা রাখে দল। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এবার বোনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন আপন বড় ভাই মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম। এ বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই বলছেন দলীয় সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধু কন্যা যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন আমরা তার পক্ষেই কাজ করবো।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আসনটিতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়ার আগে থেকেই দলীয় নেতা কর্মীসহ জনমনে নানান জল্পনা-কল্পনা ও বিতর্ক চলে আসছিল। কে হবেন এবারের নৌকার মাঝি? এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কি সৈয়দ পরিবারেই থাকবে, নাকি এ পরিবারের বাইরে চলে যাবে, কিংবা সৈয়দ পরিবারে থাকলে পরিবারের কাকে দেয়া হবে মনোনয়ন, সে প্রশ্ন ছিল এলাকার সর্বত্র।
তবে সকল প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে লিপির পক্ষে। সৈয়দ পরিবারের দুই সহোদরসহ মোট ছয় জন মনোনয়নপত্র জমা দিলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর এখন নির্বাচনের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তারা দুই ভাই-বোন।
কিশোরগঞ্জ-১ আসনের গত উপনির্বাচনের ন্যায় এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম। কিন্তু মনোনয়ন না পেয়েও দমে যাননি তিনি। বোনের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আঁটসাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
ইতোমধ্যে এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে নামা শাফায়েত-লিপির চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু গত রবিবার (১৭ ডিসেম্বর) শাফায়েতকে সমর্থন দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। টিটুর অনুসারি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে সাফায়াতকে সমর্থন দিয়ে মাঠে আছে।
গত রবিবার (১৭ ডিসেম্বর) কিশোরগঞ্জে এক নির্বাচনী মতবিনিময় সভায় ছোটবোন লিপিকে উদ্দেশ্য করে শাফায়েত বলেন, ‘একজন মহিলা কখনও নৌকার মাঝি হতে পারে না। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী। নৌকা পাইনি, কিন্তু নৌকার বৈঠা আমার হাতে। আমিই নৌকার মাঝি। জানি কোন দিকে নৌকা চালাতে হবে।’ তার এই বক্তব্যে দলের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই অসন্তুষ্ঠ। কারণ দলের প্রধানও একজন নারী।
মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) রাতে জেলা শহরের বত্রিশ এলাকায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী শাফায়াতের এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাকে অনতিবিলম্বে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানান। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর হাসিনা হায়দার চামেলী শাফায়েতুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে তার বক্তব্যে বলেন, দলের প্রধান দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা একজন মহিলা, একজন মা। তিনি যদি দলের প্রধান হতে পারেন তবে জাকিয়া নুর লিপি কেন কিশোরগঞ্জের নৌকার মাঝি হওয়ার যোগ্য না এর উত্তর আপনাকে দিতে হবে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মামুন আল মাসুদ খান বলেন, দল যদি করতে হয়, আওয়ামী লীগ যদি করতে হয়, তবে দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করতে হবে। দলের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে সে যে কেউই হোক তার নির্বাচন যারা করছেন তারা দলের কেউ নন, আওয়ামী লীগে তাদের কোন স্থান নেই।
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপির সহোদর ছোট বোন সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপা বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন উজান ভাটি নেই, বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশের। ঠিক তেমনি জননেত্রী শেখ হাসিনার কোন উজান ভাটি নেই, আমার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের কোন উজান ভাটি নেই, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কোন উজান ভাটি নেই, তাঁরা সারা বাংলাদেশের। ঠিক তেমনি আমাদের মার্কা নৌকা, তারও কোন উজান ভাটি নেই নৌকা সারা বাংলাদেশের। এই নৌকার ব্যানারেই আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, এবারও এই নৌকার ব্যানারেই আমরা নির্বাচনে জয়যুক্ত হব ইনশাআল্লাহ। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার বোনকে নৌকার মনোনয়ন দিয়েছেন আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা ভাই বোনেরা মিলে তার জন্য কাজ করছি এবং অনবদ্ধভাবে কাজ করে যাব, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এ কাজে আমরা আপনাদেরকে পাশে চাই, আপনাদের অংশগ্রহণ চাই।
অন্যদিকে জাকিয়া নূর লিপি তার বক্তব্যে বলেন, আমি দলকে সুসংগঠিত করতে, প্রতিটি ইউনিয়নে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেইসাথে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ভাই সৈয়দ আশরাফের ইমেজ, আদর্শ ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করছি। লিপি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে একাধিক প্রার্থী- এটা ঠিক আছে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।’
তিনি আরোও বলেন, ’মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমার উপর ভরসা করে যে দায়িত্ব ন্যাস্ত করেছেন আমি তার ব্যত্যয় ঘটতে দিবো না। কিশোরগঞ্জের এই মাটি আমার কাছে পবিত্র, এ মাটির মানুষ আমার নিজের মানুষ। এটি আমি সবসময় নিজের মধ্যে লালন করি।’
এদিকে শাফায়েত-লিপির অন্য তিন ভাই-বোন, ড. সৈয়দ মঞ্জরুল ইসলাম, ড. সৈয়দ শরিফুল ইসলাম ও সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপা তাদের বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপির পক্ষে এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সৈয়দ পরিবারের প্রতি এ আসনের মানুষের দুর্বলতা রয়েছে। তবে একই পরিবার থেকে তিনজন প্রার্থী হওয়ায় এতদিন অনিশ্চিয়তায় ছিলাম। এখন টিটু প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে শাফায়াতকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে সমীকরণটি আরো জটিল রূপ ধারণ করেছে। সৈয়দ পরিবারে বিভক্তি আমরা কখনোই আশা করি না।


























