হিয়ামনি এসেছে যাত্রাবাড়ী থেকে। সঙ্গে আছে বাবা এবং ভাই। আবিষ্কার প্রকাশনীর স্টলে এসেই প্রথমে চোখে পড়ে ঢাকায় ১০০ ভূত বইটি। হিয়ামনি বাবার কাছে বইটি কিনে দিতে চায়। বাবা বলেন, তুমি তো মাদ্রাসায় পড়ো এই বই তোমার কোনো কাজে লাগবে না। সঙ্গে সঙ্গে হিয়ামনির উত্তর আমি এই বই না কিনে কিছুতেই এই দোকান থেকে যাব না। এবার হিয়ামনির প্রতি দৃষ্টি পড়ে লেখক দেলোয়ার হাসানের। তিনি বাবাকে বইটি কিনে মেয়েকে দেবার অনুরোধ জানান। ভদ্রলোক অনিচ্ছাসত্ত্বেও বই কিনে দেন। হিয়ামনির মুখে তখন ভুবনজয়ী হাসি। সৌভাগ্যবশত এই প্রতিবেদক তখন এই স্টলের সামনে ছিলেন। তিনি এই মধুর দৃশ্যটি পুরোপুরি অবলোকন করেন। এদিন মেলায় নতুন বই যুক্ত হয়েছে ২৩৪টি।
গত বুধবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে অমর একুশে বইমেলায় ছিল উপচেপড়া ভিড়। সকালে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে মেলায় আসতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই এসেছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। কেউ এসেছে মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে। কেউবা এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে। দল বেঁধে মেলায় ঘুরতে দেখা যায় সবাইকে। কাউকে কাউকে একা মেলায় ঘুরতে দেখা যায়। হিয়ামনির মতো বহু শিশুকে দেখা যায়, মা-বাবার সঙ্গে জেদ করে মেলা থেকে বই কিনছে। এদিন বিক্রেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ কেউ খুব হাসিখুশি ছিলেন। বলেন, আজ ক্রেতার ভিড় বেশি, স্বাভাবিক কারণে বিক্রিও বেশি। কেউ কেউ বলেন, যত দর্শনার্থী ক্রেতা অত বেশি না। ক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলক কম।
পুরো মেলা ঘুরে দেখা যায়, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি স্টলেই ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপচেপড়া ভিড়। বড়দের সঙ্গে মেলায় শিশু-কিশোরদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। শিশু-কিশোর, তরুণদের কোলাহলে সারা দিন মুখর ছিল মেলাপ্রাঙ্গণ। মেলায় বেশিরভাগ মেয়ে কেউ কালো শাড়ি কেউ বা সাদা শাড়ি পরে এসেছে। সঙ্গে খোঁপায় ফুলের মালা, সঙ্গে বাহারি ডিজাইনের গয়না। সঙ্গে থাকা ছেলেরা পরেছে কালো রঙ্গের পাঞ্জাবি। কোনো কোনো পরিবার একই বুটিক হাউস থেকে একই ডিজাইনের পোশাক পরে এসেছে। মেলায় বিভিন্ন বর্ণের আর সাজের মানুষে মেলা হয়ে উঠে অপূর্ব রঙিন। মেলায় ঘুরে বেড়ানো দর্শনাথীদের অনেকের হাতেই ছিল অনেকগুলো বইয়ের প্যাকেট। তবে, কারো কারো হাতে কোন বই-ই ছিল না। মেলায় ঘুরতে দেশের বাইরে থেকেও এসেছিলেন অনেকে। আবার ঢাকায় বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরও দেখা গেছে মেলায় ঘুরে বেড়াতে। এদিন তারা নিজদেশের পোশাকে নয়, বাঙালির শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। মেলায় যেমন ছিল সাধারণ দর্শনাথী তেমনি ছিল ছিনতাইকারি ও ভবঘুরে বখাটে। প্রায়ই তরুণদের পকেটে হাত ঢোকানোর জন্য ভবঘুরেদের সঙ্গে রাগারাগি করতে দেখা যায়। অনেক ভবঘুরে তরুণীদের জোর করে ধাক্কা দিতে গেলে সঙ্গে থাকা তরুণটি ঐ ভবঘুরের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ চড় থাপ্পড়ও দেয়।
শিশুদের জন্য সিসিমপুর ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অনেক শিশুকে মা-বাবার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা যায় হালুম এবং টুকটুকির সঙ্গে ছবি তোলার জন্য। রাজধানীর আজিমপুর থেকে মা নিশির সঙ্গে এসেছে ছয় বছর বয়সি আলিফ। আলিফ, সিসিমপুরে আসতে পেরে খুব খুশি। সে বলে, আমার সিসিমপুরে এসে খুব ভালো লাগছে। কোনো বই কিনেছে কিনা বলায় আলিফের আম্মু নিশি হ্যান্স এন্ডারসনের রূপকথা’র গল্পের বাংলা অনুবাদটি দেখিয়ে বলেন এটা কেনা হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে এসেছে শোভন মাহমুদ। সে বলে, আমার এবার মেলায় এসে খুবই ভালো লাগছে। এবার মেলায় বই কিনেছি। চারটা আম্মু বলেছে, শেষ সপ্তাহে এলে আবার কিনে দেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে ওরা দুই বন্ধু তানিয়া আর সিরাজুল মেলায় এসেছে। দুজনে দুটি উপন্যাস কিনে দুজনকে উপহার দেয়। তানিয়া বলে, এতদূর থেকে ভিড় ঠেলে মেলায় এসেছি শুধু দুজন দুজনকে উপহার দেব বলে। রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা সিঁথি সপ্তর্ষী মা, ভাই আর বান্ধবীর সঙ্গে মেলায় এসেছে। মেলায় এসেই স্টলে দাঁড়িয়ে বই পড়ার ভঙ্গিতে একটা ছবি তুলে আবার হাঁটা শুরু করে। এমন দৃশ্য প্রায় স্টলেই দেখা যায়।
মেলায় এসেছেন ভ্রাম্যমাণ বই বিক্রেতা টিপু সুলতানও। তিনি ফেরি করে বিক্রির পাশাপাশি বইপ্রেমীদের নিয়ে জমিয়েছেন আসর। দিচ্ছেন তার লেখা বই নিয়ে বক্তব্য। মেলায় বেলা ৩টার দিকে দেখা যায় হিরো আলম একটি স্টলে এসেছে। কিন্তু তার আসার কিছুক্ষণ পরেই কিছু তরুণ ভুয়া ভুয়া স্লোগান তোলে। এরপর হিরো আলম সেখান থেকে চলে যায়। এরপর সেখানে পাটের পণ্যের প্রসার ঘটাতে আপাদমস্তক পাটপণ্যে সজ্জিত এক তরুণ আসে এবং সে পুরো মেলাজুড়ে পাটপণ্যের প্রসারে প্রচার চালায়।
প্রকৃতি ও জীবন স্টলে উপস্থিত ছিলেন মুকিত মজুমদার বাবু। তার স্টল থেকে বই কিনে ক্রেতারা সঙ্গে ছবি তোলেন। মেলায় আসা নূরজাহান ইয়াসমিন বলেন, ছুটির দিন পাওয়ায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে মেলায় এসেছি। মা-বাবা, ছোট-ভাইবোন, আমার ছেলেও আছে। কে কোন বই কিনেছে জানতে চাইলে তিনি সবার বই দেখান। বাবা কিনেছে একটি রাজনীতি বিষয়ক বই, মা একটি উপন্যাস কিনেছে। নিজে কিনেছেন দুটি কবিতা ও গল্পের বই। ভাইয়েরা এবং ছেলের জন্য কোনো বই নেই। কিন্তু কেন জানতে চাইলে বলেন, ওরা তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ওরা বাংলা পড়তে পারে না। তবে, মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, মেলার পরিসর এত বড় এবং বিস্তৃত যে, ক্রেতারা হেঁটে হেঁটে স্টল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পছন্দের বই কেনার জন্য কেউ কেউ মেলার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ঘুরছেন। কিন্তু সঠিক স্টল খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
তরুণ শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ বই কিনতে আগ্রহী। পছন্দের বই কিনতে চাইছে কিন্তু দামের কারণে পারছে না। এমনই একজন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া তাবাসসুম বলেন, অনেকগুলো স্টল ঘুরে দেখলাম। বেশ কয়েকটা বই পছন্দও হয়েছে কিন্তু আমরা কিনতে পারিনি। কারণ বইগুলোর দাম অনেক বেশি। একটা বইয়ের দাম তো নয়শ আশি টাকা চাইল। সমস্যা হচ্ছে এত টাকা দিয়ে বই কিনে তো সারা মাস চলতে পারব না। তাই আমরা অনেক খুঁজে একটু কম দামের দুটো বই কিনেছি। সেই বই দুটোই বন্ধুরা মিলে ভাগ করে পড়ব। আমাদের মেলা ঘোরাও হলো। বই কেনাও হলো। বই পড়াও হলো। একসঙ্গে সব হলো।
মেলার বিভিন্ন স্টলে শিশুদের বই কেনার জন্য কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। কিন্তু অভিভাবকদের ধমকে অনেক শিশু বই না কিনে মন খারাপ করে ফিরে যায়। এ প্রসঙ্গে প্রকাশক দেলোয়ার হাসান বলেন, এই বইমেলা হচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের মেলা। এখানে যেসব পরিবার আসে তারা সবারই খুব হিসেব করে সংসার চালাতে হয়। এরমধ্যে তারা যে কষ্ট করে সন্তানকে বই কিনে দিচ্ছে এটাই অনেক। আর ধনীরা তো এই মেলায় আসেই না বলতে গেলে। তারা এলে তাদের বই কেনা দেখেই বোঝা যেত।
মেলা প্রাঙ্গণে ছিল দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। সকাল ৮টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। স্বরচিত কবিতাপাঠে প্রায় ১৩৫জন কবি কবিতা পাঠ করেন। সভাপতিত্ব করেন কবি শামীম আজাদ। বিকেলের দিকে গবেষক সাইমন জাকারিয়ার সঙ্গে ছিলেন ফ্রান্সের দেবোরাহ জান্নাত। তিনি ইতিমধ্যে লালন সাধিকা হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। বিকাল ৪টায় মেলা প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত জায়গায় হয় সাধুসঙ্গের ৪৯১তম আসর। এই আসরে লালনের গান করেন জান্নাত। সাধুসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পাবনার ফকির আবুল হাশেম, বরিশালের শাহ আলম দেওয়ান, মানিকগঞ্জের অন্তর সরকার, জামালপুরের হেলাল উদ্দিন, সিরাজগঞ্জের গুঞ্জের আলী জীবন, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শিলা মল্লিক।
তবে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইমেলায় ঢুকতে এবং বের হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে দর্শনার্থীদের। ঢোকার স্থান সরু হওয়ায় অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। আবার বের হওয়ার সময়ও একই সমস্যায় পড়ে অনেকে। এদিন মেট্রোরেলে ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ভিড়। এতে ভিড় এর আগে দেখা যায়নি মেট্রোতে। মেলার লিটলম্যাগ চত্বরে দেখা যায়, দুয়েকটি স্টলে নীলক্ষেতের ফুটপাতের মতো করে শিশুতোষ বই বিক্রি করছেন কেউ কেউ।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত লেখক বলছি অনুষ্ঠানে এদিন নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, শিশুসাহিত্যিক ওয়াসিফ এ খোদা, কথাসাহিত্যিক মাসউদ আহমাদ এবং শিশুসাহিত্যিক ইমরান পরশ। বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চে বিকাল ৫টায় প্রথম কবিতার বই: অনুভূতির দলিল এই প্রতিপাদ্যে গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন আশনা হাবিব ভাবনা, স্নিগ্ধা বাউল, সঞ্জয় ঘোষ, রিপন আহসান রিতু, মীর রবি, মাশরুরা লাকী ও মিনহাজুল হক। সঞ্চালনা করেন কবি ফারহান ইশরাক ও কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফ। অমর একুশে বক্তৃতা দেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হাসান কবীর। সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) শাহাদাৎ হোসেন।
একুশের বক্তৃতায় আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, বাঙালি জাতির কাছে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এখন আর একটি নাম মাত্র নয়, বাঙালি জাতির পথ চলার এক নিরন্তর অনুপ্রেরণা, এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই সংগ্রাম করে তিনি জীবনের পথে, কর্মের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, আমিনুর রহমান সুলতান, হাসানাত লোকমান, বদরুল হায়দার, ফারহানা রহমান, সঞ্জীব পুরোহিত, নূর-এ-জান্নাত, শিমুল পারভীন এবং আরেফিন রব। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আশরাফুল আলম, রূপা চক্রবর্তী ও আহ্কামউল্লাহ। এছাড়া ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী এবং মানজারুল ইসলাম সুইটের পরিচালনায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, শিবু রায়, মহাদেব ঘোষ, মিথুন জব্বার, বাবু জব্বার, আব্দুল হালিম খান, স্বর্ণময়ী মণ্ডল এবং জান্নাত-এ-ফেরদৌসী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন প্রিয়ব্রত চৌধুরী (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কী-বোর্ড), মনির হোসেন (গিটার) এবং মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড)।
স/মিফা





















