ইন্ডিয়া জোটের জনসভা মঞ্চে (ডান থেকে) কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়াল ও ঝাড়খন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেন। ইন্টারনেট।
◉ বিয়ে করতে চাইলে নির্বাচনের আগেই করুন
◉ বন্দিদের নিয়ে ১৬ বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদের উদ্বেগ
◉দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার প্রতিশ্রুতি কেজরিওয়ালের
ভারতের বর্তমান সংসদ সদস্যের ৪৪ শতাংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার ২৯ শতাংশের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এসব ফৌজদারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে খুন, খুনের চেষ্টা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি, অপহরণ ও নারী-সংক্রান্ত মামলা। এদিকে সর্বভারতীয় সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চার (এআইডিএফ) প্রধান মাওলানা বদরুদ্দীন আজমলকে কটাক্ষ করে বিজেপিদলীয় প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ধুবরির সংসদ সদস্য (আজমল) যদি আবারও বিয়ে করতে চান, তা নির্বাচনের আগেই সেরে ফেলা উচিত, পরে করলে গ্রেপ্তার হতে হবে। অন্যদিকে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাকারী লেখক, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের বিনা বিচারে কারাগারে বন্দি রাখার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের শীর্ষ ১৬ শিক্ষাবিদ।
গত শনিবার প্রকাশিত ভারতের অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ৫১৪ সংসদ সদস্যের পেশ করা হলফনামা পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদন করেছে এডিআর।
এডিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫১৪ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২১৫ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ৯ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে খুনের মতো অপরাধের মামলা। এই ৯ জনের মধ্যে পাঁচ জনই বিজেপিদলীয় সংসদ সদস্য। আবার ২৮ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। আর এই ২৮ জনের মধ্যে ২১ জনই বিজেপির সংসদ সদস্য। এই সংসদ সদস্যের মধ্যে ৫ শতাংশ ১০০ কোটি রুপির বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক। এই তালিকায় প্রথম তিনে রয়েছেন কংগ্রেসদলীয় সংসদ সদস্য নকুল নাথ, ডি কে সুরেশ ও স্বতন্ত্র রঘুরাম কৃষ্ণ রাজু।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে ৭৩ শতাংশ সংসদ সদস্য স্নাতক পাস। এসব সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন অধিবেশনে শতভাগ উপস্থিত থেকে রেকর্ড গড়েছেন। তারা হলেনÑ রাজস্থানের আজমিরের সংসদ সদস্য ভগীরথ চৌধুরী এবং ছত্তিশগড়ের কাঁকের আসনের সাংসদ মোহন মান্ডবী। তারা কোনোদিন অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন না। বর্তমান লোকসভার অধিবেশন বসেছিল মোট ২৭৩ দিন। ১২০ সংসদ সদসস্যের উপস্থিত হার ছিল ৯০-এর বেশি। কংগ্রেসের সদস্য সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীর সংসদ অধিবেশনে উপস্থিতির হার ছিল যথাক্রমে ৪৯ ও ৫১।
এদিকে ভারতে প্রস্তাবিত ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) প্রসঙ্গ তুলে বিজেপিদলীয় প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ধুবরির সংসদ সদস্য (মাওলানা আজমল) যদি আবারও বিয়ে করতে চান, তা নির্বাচনের আগেই সেরে ফেলা উচিত, পরে করলে গ্রেপ্তার হতে হবে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ইন এবং এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের পরে রাজ্যে ইউসিসি প্রয়োগ করা হবে। এতে করে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ অবৈধ হয়ে যাবে। তখন মুসলিম পরিবারিক আইন আর কার্যকর থাকবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এই ইউসিসিই মেনে চলতে হবে।
এবারও লোকসভা নির্বাচনে ধুবরি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এআইডিএফ প্রধান মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের মানুষ আর রাকিবুল হোসেইন (ওই আসনে তার কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী) বলেছেন, আমার বয়স হয়েছে। তবে এখনো আমার মধ্যে বিয়ে করার মতো জোর আছে। মুখ্যমন্ত্রী না চাইলেও আমি তা করতে পারব।’
গত শনিবার এক নির্বাচনী সমাবেশে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তার (আজমলের) এখনই বিয়ে করা উচিত। নির্বাচনের পর আসামে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) চালু করা হবে। এর পরে বিয়ে করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিয়ে, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও দত্তক নেওয়ার বিষয়ে অভিন্ন বিধিমালার নাম ইউনিফর্ম সিভিল কোড। এটি পাস হলে ভারতীয় নাগরিকদের সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
অন্যদিকে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাকারী লেখক, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী রাখার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের শীর্ষ ১৬ শিক্ষাবিদ। একইসঙ্গে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে বিচার বিভাগসহ প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ‘ভারতে মৌলিক স্বাধীনতার অবমাননা’ শীর্ষক বিবৃতিতে এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন লেখক অমিতাভ ঘোষ, মার্কিন অধ্যাপক মার্থা নাসবাউম, ওয়েন্ডি ব্রাউন, শেলডন পোলক প্রমুখ। এ বিবৃতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও।
বিবৃতিতে বলা হয়, ৭৫ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, লেখক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে ছয় মাস কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়নি। তার অফিস-বাসায় কয়েক সপ্তাহ ধরে অপরাধসংক্রান্ত প্রমাণের খোঁজে বারবার তল্লাশি চালানো হয়েছে। তবে কিছুই পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নজরে আসা উচিত।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, অন্যদের আরো দীর্ঘ সময় ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যেমন (ভীমা) কোরেগাঁও মামলায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা (চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কারণে আদালত যাঁদের জামিনে মুক্তি দিয়েছেন তারা ব্যতীত) কোনো বিচার ছাড়াই পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। দিল্লির দাঙ্গায় অভিযুক্ত অনেককে দীর্ঘ সময় কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। এই সময়টা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে যে সর্বোচ্চ সাজা হয়, তারচেয়েও বেশি। ভারতে ঘটা এসব ঘটনার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর দেওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে ভারতে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে দেশটির কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে বিচার বিভাগকে আহ্বান জানান তারা।
এদিকে আলাদা বিবৃতিতে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারত যে গণতন্ত্রের দাবি করে, তা অভিযুক্ত মানুষকে বিনা বিচারে কারাবন্দী করে রাখার চর্চার মাধ্যমে ‘দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত’ হয়েছে। ভারতে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। তবে দেশটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট যেসব অন্যায় করছে, নিশ্চিতভাবে তার একটি হচ্ছে বিনা বিচারে কারাবন্দী করে রাখা।
এদিকে গতকাল দিল্লির বিখ্যাত রামলিলা ময়দানে ময়দানে বিরোধী জোট ‘ইনডিয়া’র আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে রাজধানী নয়াদিল্লির কারাবন্দি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়াল বলেছেন, ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার কেন্দ্রীয় বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করছে। ভারতের জনগণ কেজরিওয়ালের সাথে আছে। তাকে আজীবনের জন্য কারাগারে রাখতে পারবেন না। হাজার হাজার নেতাকর্মীর সামনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা দেন তিনি। এ সময় কারাবন্দি কেজরিওয়ালের পাঠানো একটি চিঠি সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীদের পাঠ করে শোনান সুনিতা কেজরিওয়াল।
চিঠিতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল বলেছেন, দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া এবং দেশের প্রত্যেকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করাই তার মূল উদ্দেশ্য। ‘লোকতন্ত্র বাঁচাও’ নামে আয়োজিত সমাবেশে কেজরিওয়ালের দেওয়া প্রধান নির্বাচনী ছয় প্রতিশ্রুতি : নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, বৈপ্লবিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া।
চিঠিতে কেজরিওয়াল লিখেছেন, ‘প্রিয় ভারতবাসী, আজ আমি আপনাদের কাছে ভোটের আবদার করছি না। নির্বাচনে জয় পেতে কাউকে পরাজিত করার বিষয়েও আমি আজ কথা বলছি না। আমি ভারতকে নতুন ভারত হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে কথা বলছি। আমাদের দেশের সবকিছুই আছে। আমি কারাগারে, এখানে আমি চিন্তা করার প্রচুর সময় পাচ্ছি। আমি ভারত মাতার জন্য চিন্তা করছি। ভারত মাতা আজ বেদনায় কাতর, কারণ মানুষ সুশিক্ষা পাচ্ছে না, সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে, রাস্তাঘাট ভাঙা।’
ভারতের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে গত ২১ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মদ নীতি কেলেঙ্কারির মামলায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত আগামী ২৮ মার্চ পর্যন্ত তার রিমান্ড মঞ্জুর করে ইডি হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়।
























