◉ ১৭৯টি জলযানবিশিষ্ট একটি সুগঠিত বাহিনীতে পরিণত
◉গত ১৪ বছরে আরো শক্তিশালী, যুগোপযোগী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে
◉ ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় বিশেষ কার্যক্রম
◉ চোরাচালান দমন ও নিরাপত্তায় অব্যাহত সফল অভিযান
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সামুদ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে কোস্ট গার্ডের ভূমিকা পালন করে আসছিল। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা, উপকূলবর্তী জনগণের যথাযথ নিরাপত্তা বিধানে উত্তাল সমুদ্রের বৈরিতাকে সঙ্গী করে সার্বক্ষণিক নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব ও এর সম্পদ রক্ষা, উপকূলীয় এলাকায় জানমাল ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য কোস্ট গার্ড যেকোনো দেশের জন্য অপরিহার্য একটি বাহিনী। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে সমুদ্রতীর হতে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সংলগ্ন এলাকা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের সকল অধিকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের। স্বাধীনতার পর এ গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ পাস করা হয়। এরও দুই দশক পর ‘কোস্ট গার্ড অ্যাক্ট ১৯৯৪’ মহান জাতীয় সংসদে পাস করার মাধ্যমে গঠিত হয় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে এই বিলটি উত্থাপন করেন। একটি আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে ‘গার্ডিয়ান অ্যাট সি’ মূলমন্ত্রে ১৯৯৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হতে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বিগত ১৪ বছরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জাহাজ, বেইস, স্টেশন ও আউটপোস্ট সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড হয়েছে আরো শক্তিশালী, যুগোপযোগী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ১৭৯টি জলযানবিশিষ্ট একটি সুগঠিত আইন প্রয়োগকারী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের দূরদৃষ্টি এবং উন্নয়নের ক্রমধারায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে উত্তরোত্তর যুগোপযোগীকরণের প্রয়াস চলমান রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাফল্য নিয়ে প্রকাশিত ‘বদলে যাওয়ার ১৫ বছর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন সূত্রমতে, ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এ সংযোজিত উল্লেখযোগ্য জলযানের মধ্যে রয়েছে- ইনশোর প্যাট্রল ভেসেল (আইপিভি) ৭টি; অফশোর প্যাট্রল ভেসেল (ওপিভি) ৪টি; ফাস্ট প্যাট্রল বোট (এফপিবি) ৫টি; হারবার প্যাট্রল বোট (এইচপিবি) ৬টি; টাইফুন ক্লাস বোট ৬টি; আর বোট (ভিআইপি) ১টি; ডলফিন ক্লাস বোট ১৬টি; ডিফেন্ডার ক্লাস বোট ৫টি; মেটাল শার্ক বোট ২০টি; ফ্লোটিং ক্রেন ১টি; অয়েল পলিউশন কন্ট্রোল বোট ৪টি; রেসকিউ বোট ২০টি; হাইস্পিড বোট (বড়) ৬টি; সী হর্স ক্লাস বোট ৯টি; ক্লোটিং ক্রেন ১টি; ডিফেঞ্জার ৫টি; কেন্যু বোট ৪টি; সেইলিং বোট ২টি এবং স্টিংরে ক্লাস ১০টি।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষার অভিযানে ১ জানুয়ারি ২০১২ হতে এ পর্যন্ত সর্বমোট টাকা ২১ হাজার ৭২৯ কোটি ২৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের কারেন্ট জাল বেহুন্দি/মশারি জাল, চরঘেরা/অন্যান্য জাল, জাটকা, চিংড়ি/ফাইসা পোনা আটক করে।
বর্তমান সরকারের শাসনামলে গত ১ জানুয়ারি ২০০৯ সাল হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এর জন্য ১টি ট্রেনিং বেইস (বিসিজি ট্রেনিং বেইস অগ্রযাত্রা), ২টি বেইস (বিসিজি বেইস কক্সবাজার ও রাবনাবাদ) টিওএন্ডইভুক্ত করা হয়েছে এবং ২টি বেইস (বিসিজি বেইস সুন্দরবন ও পূর্ণাঙ্গ বেইস এর সুবিধাসহ একটি ডকইয়ার্ড এর প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এর জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ১৭টি স্টেশন যথা উড়িরচর, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, সুপতি, দোবেকী, কোকিলমনি, পুষ্পকাঠি, নিদ্রাছকিনা, গজারিয়া, হিজলা, মাতারবাড়ি, পায়রা, ঢালচর, রামগতি ও কম্পোজিট স্টেশন পদ্মা টিওএন্ডইভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মিরশ্বরাই, ভেদরগঞ্জ, কম্পোজিট স্টেশন ভাসানচর, কমলনগর, রায়পুর, নেছারাবাদ, ভান্ডারিয়া, বরিশাল, আন্দারমানিক, কালাইয়া, লালমোহন, কাগাদোবেকী, কালীগঞ্জ, ইনানী, হিমছড়ি, ইলিশা, সোনাগাজী ও কুয়াকাটাসহ সর্বমোট ১৮টি স্টেশন স্থাপনের প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এর জন্য পতেঙ্গা, শাহপরী, নরম্যান্স পয়েন্ট, কচিখালী, নলিয়ান, তজুমুদ্দিন, চরমানিকা, দুবলারচর, সোনাদিয়া, নয়নআনি লক্ষ্মীপুর, সারিকাইত, রামগতি, টেকনাফ ও রাঙ্গাবালীসহ ১৪টি আউটপোস্ট টিওএন্ডইভুক্ত করা হয়েছে এবং ১টি নতুন আউটপোস্ট বাহারছড়া স্থাপনের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
২০১৩ হতে ২০২৩ পর্যন্ত ইয়াবা, বিয়ার, দেশি/বিদেশি মদ, বিদেশি সিগারেট, ক্রিস্টাল মেথ আইস ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক আটক করেছে কোস্টগার্ড। ২০১২ হতে ২০২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের ৫৯৮ টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৪৯৪ রাউন্ড তাজা গোলাভবারুদ ও ৩২৪ রাউন্ড ব্ল্যাংক কার্টিজ উদ্ধার করে। ২০১৩ হতে ২০২৩ পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরকিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা সম্ভব হয়েছে ১৬ হাজার ৬৩৮ জন; আটককৃত দালাল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৮৫জন এবং মৃতদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৫২টি।
সোনালি ধানের এই দেশে মাছ উৎপাদনে রুপালি ইলিশের হিস্যা ১১ শতাংশ এবং বার্ষিক দেশজ উৎপাদনে এক শতাংশ। অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে কোস্ট গার্ড-এর অভিযানে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ করে। মা ইলিশ রক্ষায় সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রজননক্ষেত্রগুলোতে ইলিশ ধরা বন্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মৎস্যসম্পদ, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।
দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ কোটি ৬০ লাখ টাকা সমপরিমাণ মূল্যের পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় মোট ৬৪ হাজার ৯৫৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্ট গার্ড।
২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এর জন্য বিভিন্ন জোন, বেইস, স্টেশন, আউটপোস্ট ও জলযানের অনুকূলে ৩০১৩ জন জনবল সাংগঠনিক কাঠামোতে (টিওএন্ডই) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ১০ বছরে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতদের দ্বারা জিম্মিকৃত ১,৭৯৩ জন বিপন্ন জেলে/বাওয়ালিসহ ৪৫৬টি বোট উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। একই সময়ে চোরাচালান দমন অভিযানে এ বাহিনীর সদস্যগণ শুল্ক ফাঁকি দেয়া বৈদেশিক শাড়ি, থ্রি পিস, লেহেঙ্গা, অক্টেন/ডিজেল, বার্থিং হাউজার/নাইলন রোগ, স্বর্ণ ইত্যাদি অবৈধ পণ্য জব্দ করে প্রায় এক হাজার ৪৫ কোটি ১৭ লক্ষ ৪০ হাজার ৪৪৩ টাকার পণ্য কাস্টমস ও শুল্ক পরিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেছে।
অবকাঠামোগত সক্ষমতার মাইলফলক :
‘পটুয়াখালীতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গত ২০১৪ সালে পটুয়াখালীতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড-এর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বিসিজি বেইস অগ্রযাত্রা এর প্রশাসনিক ভবন, ট্রেনিং স্কুল বিল্ডিং, মসজিদ এবং গার্ডসমূহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসমূহ নির্মিত হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৩০ জুন ২০১৪ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘বিসিজি বেইস অগ্রযাত্রা’ কমিশনিং করা হয়েছে।
জানুয়ারি ২০১৬ হতে জুন ২০১৮ এর মাধ্যমে কোস্ট গার্ড সদর দপ্তর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ভোলায় অফিসার্স মেস এবং বিসিজি বার্থ পতেঙ্গায় অফশোর প্যাট্রল ভেসেল (ওপিভি) বার্থিং সুবিধার জন্য ফিজিক্যাল অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য ‘লজিস্টিকস ও ফ্লিট মেইনটেন্যান্স ফ্যাসিলিটি গড়ে তোলা’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ হতে শুরু হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ২টি স্লিপওয়ে, ৫টি ওয়ার্কশপ (যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদিসহ), ১টি বোট ইয়ার্ড ও ইয়ার্ড সার্ভিস ফ্যাসিলিটি, ১টি ফুয়েল স্টোরেজ ডিপো এবং ১টি প্রশাসনিক ভবনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোসমূহ নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে ডকইয়ার্ডে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের নিজস্ব জাহাজ ও বোটসমূহের বিভিন্ন ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হবে।
উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যায়ক্রমিকভাবে মোট ৩০টি (সিসিএমসি) নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ২০১৩ সালে ১১টি, ২০১৪ সালে ২টি, ২০১৫ সালে ৮টি, ২০১৬ সালে ২টি সিসিএ- মসিও ২০১৯ সালে ৩টি সহ মোট ২৭টি সিসিএমসি নির্মাণ শেষে বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে ৩টি সিসিএমসি নির্মাণের জন্য কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ঠঝঅঞঘঊঞ কমিউনিকেশন সিস্টেম সংযোগ করা হয়েছে।






















