❖চুক্তিভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দিন হাজিরা ২১৩ টাকা
❖টেন্ডারের ফাঁদে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিকরা
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) একজন চুক্তিভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী দৈনিক ২১৩ টাকা মজুরি পান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে নামমাত্র এই টাকায় তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, তার পরও পেটের টানে বাধ্য হয়েই এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন তারা। ডিএনসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত একজন পরীচ্ছন্নতাকর্মী যেখানে ১৮ হাজার টাকা মাসিক বেতন পান, সেখানে চুক্তিভিত্তিক একজন মাসে ৩০ দিন কাজ করলে পান ৬ হাজার ৩৯০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২১ সালে তৃতীয়পক্ষকে টেন্ডারের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দুই সিটি কর্পোরেশন। এরপর থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা টেন্ডার পাওয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করছে। ডিএনসিসির টেন্ডার পাওয়া কোম্পানিগুলো হলো, ক্লিনটেক ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, এম/এস মাল্টি-ইন্টারন্যাশনাল, এবং রাকিব এন্টারপ্রাইজ কর্মী। প্রায় ৩ হাজার ৫০৯ জন কর্মী এসব কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে আছে। এর মধ্যে ২,৬৬৩ জনকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসাবে এবং ৮৪৬ জনকে মশক কর্মী হিসাবে স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা নিয়োগ করা হয়েছে। টেন্ডারে ডিএনসিসি এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ন্যূনতম কোনো মজুরি নির্ধারণ করে দেয়নি। এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে কর্মীদের মজুরি কর্তণ করছে কোম্পনিগুলো। যদিও কোম্পানিগুলো ডিএনসিসিকে কাগজে-কলমে মজুরি ৪০০-৫০০ টাকা দেখিয়েছে। তবে বাস্তবে তারা পরচ্ছিন্নতাকর্মীদের সে পরিমাণ টাকা দিচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ অনুসারে, একটি চার সদস্যের পরিবারের দৈনিক খাবারে প্রাণিজ প্রোটিন দিয়ে খাদ্য খরচ মেটাতে ২২,৬৬৪ টাকা প্রয়োজন। এসব কর্র্মীরা ভোর ৪ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত কাজ করে আবার সংসার খরচ চালাতে কেউ রিকশা চালক, কেউ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
বনানী এলাকায় কর্মরত এম/এস মাল্টি-ইন্টারন্যাশনাল-এর মাধ্যমে নিয়োগ করা মশক কর্মী সাইফুল বলেন, স্প্রে করে মাসে আমার আয় ১০,০০০ টাকা। বাড়ি ভাড়া, ইউটিলিটি বিল, খাবার ও চিকিৎসার খরচ এবং আমার তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ আছে। এই অল্প টাকায় এত খরচ সামলানো মুশকিল। তার পরও মাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা আসে। তাই কষ্ট হলেও কাজ করি। স্ত্রী কয়েকটি বাসায় রান্নার কাজ করে কোনোরকমে পেটে খাবারের ব্যবস্থা করে। আমার খণ্ডকালীন চাকরি করার সুযোগ নেই কারণ আমাকে সকাল-সন্ধ্যা কাজে উপস্থিত থাকতে হয়। মাঝেমাঝে মনে হয় চাকুরি ছেড়ে গ্রামে চলে যায়, কিন্তু নিজের বা বাবার সম্পত্তি নইে সেখানে যেয়েই কি করব।
ক্লিনটেক লিমিটেডের অন্তত ২০ জন কর্মী জানান, তারা মাসে ৬,৪০০-৮,০০০ টাকা পায় এবং নিয়মিত উপস্থিতির জন্য অতিরিক্ত ৫০০ টাকা পায়। আর যারা সর্বনিম্ন ২১৩ টাকা পান তারা ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে মাসিক ৬ হাজার ৪০০ টাকা পান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ভোর ৪টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করি। সংসার চালাতে আবার দুপুর থেকে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করি। যে বস্তিতে থাকি সেখানে একটি ঘরের খরচ ৩ হাজার টাকা। সন্তানদের জন্য ভালো খাবার কেনা কঠিন আমার জন্য। তাদের ঠিকঠাক যত্নও করতে পারি না।
২০১৮ সালে শ্রম আইনের সংশধোনী অনুযায়ী, একজন দক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি হলো ১৭,৯১০ টাকা যেখানে ক্লিনার এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মীর মতো একজন অদক্ষ ব্যক্তির জন্য ১৭,৬১০ টাকা। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক ডাকা চারটি দরপত্রের তদন্তে দেখা গেছে যে ন্যূনতম মাসিক মজুরির মান নির্ধারিত না থাকায় শ্রমিকদের খুব কম বেতন দেওয়া হয়।
ক্লিনটেক লিমিটেড ২০২২ সালের জন্য ১৪ কোটি ৯৭ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকায় ওয়ার্ড-১ এবং জোন-৬-এর বর্জ্য পরিষ্কারের পরিষেবার জন্য টেন্ডার পায় যা পরবর্তীতে নবায়ন করা হয়। চিঠিতে কোম্পানিটি ৩৩০ জন অদক্ষ ক্লিনারের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক ৪৫০.০০১ টাকা প্রদান করলেও তাদের দৈনিক মাত্র ২১৩ টাকা দেওয়া হয়।
মেসার্স মাল্টি-ইন্টারন্যাশনালেরন স্বত্বাধিকারী হাসান মো. রানা জানান, তারা একজন স্প্রে ম্যানকে মাসে ১০ হাজার টাকা দেন। তিনি বলেন, একজন শ্রমিকের উদ্ধৃত মজুরি থেকে, আমরা কেবল শ্রমিককে পরিশোধ করি না, ১৫% মূল্য সংযোজন কর এবং ৫% আয়করও প্রদান করি। এ ছাড়াও, ব্যয়ের জন্য অনেক খাত রয়েছে। তারপর বাকি টাকা আমাদের কমিশন হিসাবে রাখা হয়।
ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (সংগ্রহ ও পরিবহন) সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা সরবরাহকারীদের জন্য দরপত্রে একটি শর্ত রাখব যাতে উদ্ধৃত অর্থের ৬০% শ্রমিকদের দেওয়া হয়।





















