❖ ১৪ বছরেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি জাতীয় শিক্ষানীতি
❖ ঝুলে আছে শিক্ষা আইন, হয়নি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন
❖ একের পর এক পদ্ধতি পরিবর্তনে ব্যাহত শিক্ষার কাক্সিক্ষত গতি
❖ নতুন কারিকুলাম চালুর পরও চলছে নানা সংস্কার, স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা
❖ নতুন নতুন পদ্ধতি আয়ত্তে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিপাকে শিক্ষকরাও
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যেন স্থিরতা আসছেই না। সর্বত্র একের পর এক পরিবর্তন-পরিমার্জন চলছেই। শিক্ষায় রূপান্তরের অংশ হিসেবে বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত চলছে নতুন শিক্ষাক্রম। ধাপে ধাপে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এই শিক্ষাপদ্ধতি। নতুন এ পদ্ধতি চালুর আগে দেশে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন চলছিল। সেটির সফলতা আসার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে পাবলিক পরীক্ষার আদলে প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষাও। দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ কারিকুলামে চলা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এনেই মূলত একের পর এক নতুন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অনেকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাঁদে পড়ে আছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষামাধ্যমে নানাভাবে চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জন। এতে শিক্ষার স্বাভাবিক ও কাক্সিক্ষত গতি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
সূত্রমতে, স্বাধীনতাপরবর্তী দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। তবে কোনো কমিশনেরই কার্যক্রম বা সুপারিশ কাজে আসেনি। প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে। ওই কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো দেশে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও পরবর্তীতে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণীত হয় এবং পরে তা জাতীয় সংসদে পাস হয়। যদিও এই শিক্ষানীতির নানা বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বিতর্ক দেখা দেয়। মূলত স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৯ বছর পর দেশে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও সেটিও নানা কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ওই শিক্ষানীতিতে একটি শিক্ষা আইন এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এতে শিক্ষার কাক্সিক্ষত গন্তব্য থেকে দেশ অনেক দূরে রয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
এদিকে শিক্ষায় ব্যাপক রূপান্তরের উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বছর দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মুখস্ত নির্ভরতার পরিবর্তে সৃজনশীলতা ও ব্যবহারিকের জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কমানো হয়েছে পাঠ্যপুস্তকের পরিমাণ, বাতিল করা হয়েছে আগের সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। গত বছর তিন শ্রেণিতে আর এবার আরও চার শ্রেণিতে এই কারিকুলাম চালু হয়েছে। তবে এই কারিকুলাম নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক দেখা দেয়, যা এখনও অব্যাবহত আছে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত-কারিকুলামটি আধুনিক হলেও দেশের প্রেক্ষাপটে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাছাড়া এতে নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক লেখাপড়ার গতি থেমে গেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কারিকুলামে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ চালাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তবে এখন পর্যন্ত এই কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন বেশিরভাগ শিক্ষক ও অভিভাবক। কারণ শিক্ষকরাই এখনো নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে তারা শ্রেণিতে ঠিকমতো বোঝাতেও পারছেন না। যে যার মতো করে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আর গ্রুপ ওয়ার্ক ও হোম ওয়ার্কের নামে ব্যস্ততার পাশাপাশি ভোগান্তিও বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। তাই নতুন এই কারিকুলামের স্থায়িত্ব নিয়েও শঙ্কায় আছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেছেন, শিক্ষার উন্নয়নে সঠিক পথ জানলেও সেপথে আমরা হাটতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে কিছু দুষ্টু চক্র বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকার অনেক ভালো উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন নেই। তিনি বলেন, এখনো জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এগোতে পারিনি। এখনো শিক্ষা আইন করতে পারিনি। হয়নি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন। এতে অনেক কিছুই করা যাচ্ছে না।
নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে এই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম ভালো, তবে বাস্তবায়নের প্রস্ততি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তারা ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছেন না। এর সমাধান সরকারকেই করতে হবে।
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন (শুক্রবার ও শনিবার) করা হয়েছে। ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা নেই। প্রাথমিক শ্রেণিতে সবার জন্য ৮টি বই এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০টি বই পড়তে হচ্ছে। শুধু এসএসসি তে গিয়ে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে। নবম শ্রেণিতে তথা এসএসসি পর্যায়ে কোনো বিভাগ থাকছে না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুইটি পাবলিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ফলাফল হবার কথা রয়েছে। যদিও নতুন কারিকুলামের বইয়ের বিভিন্ন বিষয় এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার এতে পরিবর্তন আনছে। এরই মধ্যে সংশোধিত মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। পাঠ্যবইয়েও প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক মৌলিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ করে শিক্ষায় কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। মৌলিক ন্যূনতম শিক্ষা অধিকারের ধাপ প্রাথমিক থেকে নিম্ন-মাধ্যমিক স্তরে উত্তরণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করবে। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি ও নানান আর্থ সামাজিক কারণ ও প্রক্রিয়াগত কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার রোধ করতে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক বা নামমাত্র ব্যয়ে করার ব্যবস্থা করার বিষয়ে শিক্ষানীতি ২০১০ এ বর্ণিত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ৫ মে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সম্মত হয়েছে দুই মন্ত্রণালয়।
এই লক্ষ্যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের অবৈতনিক শিক্ষা তথা পাঠদান কার্যক্রম ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করবে, এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে কাজ করবে বলে জানা গেছে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন নাহার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষায় ধারাবাহিকতা বজায় থাকাটা জরুরি। ধারাবাহিকতা না থাকলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। তিনি বলেন, দক্ষতানির্ভর পড়াশোনা না হলে চলবে না। গণহারে বিএ/এমএ পাস করিয়ে এখন আর মুনাফা পাওয়া যাবে না। কীভাবে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে হবে সে বিষয়েও নজর দিতে হবে।
নতুন কারিকুলাম প্রসঙ্গে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সারোয়ার জাহান বলেন, কারিকুলাম কখনো আমূল পরিবর্তন হয় না, পরিমার্জিত হয়। প্রতি পাঁচ বছর/ কিংবা ১০ বছর পর পর কারিকুলাম পরিমার্জিত হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে পরিমার্জন ও পরিবর্তন যে এক জিনিস নয়, তা বুঝতে হবে। পরিমার্জন করতে হয় সাম্যাবস্থা (বয়ঁরষরনৎরঁস) বজায় রেখে -যাতে পূর্বের অবস্থা থেকে পরিবর্তিত অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক না থাকে। কিন্তু মাধ্যমিকের কারিকুলাম পরিমার্জনের ক্ষেত্রে এই নীতি অবলম্বন করা হয়নি! সাধারণত ১০%- ২০% পরিবর্তন করে কারিকুলাম পরিমার্জন করা হয়ে থাকে। কিন্তু মাধ্যমিকের কারিকুলামের ক্ষেত্রে ১০০% অর্থাৎ পুরো খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হয়েছে- সেটা যেমনি কারিকুলামের নর্মস এর ক্ষেত্রে আঘাত করা হয়েছে, তেমনি লার্নিং অ্যাপ্রোচ ও বিষয় নির্বাচনেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সৃজনশীল শিক্ষার একজন মাস্টার ট্রেইনার ও শিক্ষাবিদ ড. ওয়ালী উল্লাহ বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীরা মেধাশূন্য হওয়া শুরু করে। এই পদ্ধতি ভালো বলে মনে হয়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এতে ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে পারেনি। এখন নতুন যে কারিকুলাম চালু হয়েছে, তাতেও নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
























