➤পশ্চিমাদের প্রতি কমছে আস্থা
➤ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
➤নতুন কূটনৈতিক কৌশল সাজানোর চিন্তা
➤চলছে আন্দোলনে ফেরার চেষ্টা
➤ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তায় নেতাকর্মীরা
দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। দলটির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন থাকার দাবি করলেও ক্ষমতার আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা মিলছে না। বরং রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম কোনঠাসা অবস্থায় পড়ছে দলটি। নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক আন্দোলন করেও সফলতা পায়নি দলটি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিদেশির সমর্থন আদায়েও চলছে নানা তৎপরতা। তবে তাতেও দৃশ্যত কোনো ফল আসেনি। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা তৎপরতায় বিএনপিতে বেশ আশা জাগলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভোটের পরের পরিবর্তিত দৃশ্য ও ভূমিকায় অনেকটা ক্ষোভ ও হতাশা নেমে এসেছে দলটিতে।
এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতি তাদের আস্থাও যেন কমেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বরং দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশের ভারতবিরোধী প্রকাশ্য অবস্থানে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। তবুও নতুন আশায় নতুন করে কৌশল সাজাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। একই সঙ্গে হতাশ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে দলটি ফের আন্দোলনে নামারও পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করেছিল। বিবৃতি, আলোচনা, ভিসানীতি ও শ্রমনীতি ঘোষণার মতো পদক্ষেপও নিয়েছে। তাদের এমন তৎপরতা বিএনপিকে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। দলটির ধারণা ছিল, ২০১৪ সালের মতো এবার একতরফা নির্বাচন করতে পারবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশি-বিদেশি চাপে সরকার বিরত থাকতে বাধ্য হবে এবং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের একটা পথ বের হবে। এমনকি জোর করে নির্বাচন করলেও তাতে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে না। তবে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনেকটা নির্বিঘ্নে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। একে একে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থনও তাদের প্রতি। এ অবস্থায় বিএনপি নেতারা বলছেন, দলের কূটনৈতিক উইং বা ফরেন রিলেশন কমিটির তৎপরতা ছিল খুব দুর্বল। ভূরাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
কারণ নির্বাচনের পর পশ্চিমাদের দিক থেকেও আর সেই চাপ নেই; বরং যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের কথা বলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর শেষ করে যাওয়ার সময় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু সামনে তাকানোর কথা বলে সেই বার্তাই দিয়েছেন। লুর সফর নিয়ে বিএনপির হতাশা থাকলেও তা প্রকাশ না করে সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছে দলটি। এ সফর নিয়ে বিএনপির কোনো আগ্রহ নেই বলেও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন।
সর্বশেষ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামেও বিষয়টির মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়, নির্বাচন ঘিরে সরকার পতনের আন্দোলনের পরিকল্পনায় আরও বৈচিত্র্য দরকার ছিল। কূটনৈতিক তৎপরতায়ও ঘাটতি ছিল। তবে সফলতার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকারকে সমর্থন দেয়নি বলে তারা স্বস্তি প্রকাশ করেন।
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, নির্বাচনের আগে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বশীলদের এমন মনোভাব ছিল যে, ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বেশ ভালো বোঝাপড়া হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা নিজের থেকেই সরকারের নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে বলেছে। সেটা বিএনপির পক্ষে গেছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝেও বিষয়টি ছড়িয়ে তাদের চাঙ্গা করা হয়। কিন্তু ওই দেশগুলো যে বিএনপির পক্ষে কথা বলেনি সেটা বিএনপির এ উইংয়ের কান্ডারিরা বুঝে উঠতে পারেননি।
বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ দলের শীর্ষ ফোরামে এও বলেছেন, নির্বাচন ইস্যুতে ভারত নিরপেক্ষ থাকবে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। ভারতের সমর্থন এ সরকারকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টাকে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি বিএনপির বিপক্ষে গেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, কূটনৈতিক পর্যায়ে নিরন্তর যোগাযোগ ছিল না বিএনপির বর্তমান উইংয়ের নেতাদের। শুধু চিঠি চালাচালি আর ইস্যুভিত্তিক দেখা-সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম। ফলে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভালো বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। যদিও পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রচার করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিদেশনির্ভরতা তৈরি করা হয়েছিল। এ অবস্থায় দলের কূটনৈতিক উইংয়ে পরিবর্তন আনারও আলোচনা শুরু হয়েছে দলটিতে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কূটনৈতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের পর বিএনপির ভেতরে-বাইরে কূটনৈতিক উইং নিয়ে কথা হচ্ছে। উইংয়ের দুর্বলতাও সামনে আনা হচ্ছে। এখানে কূটনৈতিক তৎপরতার অবদান কিংবা দুর্বলতার কিছু নেই। কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি তো আমরা নির্ধারণ করতে পারব না। আমাদের কাজ বিদেশিদের সামনে দেশের অবস্থা ও জনগণের আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরা। এরপর সিদ্ধান্ত তাদের। কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি জনমত উপেক্ষা করে বিশেষ একটি গোষ্ঠী বা দলকে গুরুত্ব দিতে চায়, সেটি তাদের সমস্যা। এর সমাধান তো বিএনপির কূটনৈতিক উইং দিতে পারবে না। বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই বাংলাদেশের জন-আকাক্সক্ষার পক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ায় বিএনপির মন খারাপ বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ডোনাল্ড লু ঘুরে যাওয়ায় বিএনপির নেতাদের মাথা আরও খারাপ হয়ে। ডোলাল্ড লুর সঙ্গে বিএনপি নেতারা সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছেন দাবি করে হাসান মাহমুদ বলেন, তারা (বিএনপি নেতারা) অনেক চেষ্টা করেছিলেন দেখা সাক্ষাৎ করতে। তাদের আশায় গুড়ে বালি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্তা দিয়ে গেছে তারা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, গভীর করতে চায়। আমরাও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাই।
বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা প্রসঙ্গে দলটির একসময়ের জোটসঙ্গ বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া সবুজ বাংলাকে বলেন, বিএনপি যেন সব সময় ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের ফাঁদে পড়েছিল, আর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে পড়ে আমেরিকানদের ফাঁদে। বিএনপির বিদেশ নির্ভর রাজনীতিতে সফলতা আসবে না জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেরা কিছু না করতে পারলে বিদেশিরা করে দেবে না। আন্দোলন একটা পর্যায়ে গেলে বিদেশিরা সব এক হয়ে তাদের অবস্থান জানাত। বিএনপি হয়তো বিদেশি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকা থাকবেই। তাদের এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দেশটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্পষ্ট নয়। চীনও এদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছেও বিএনপি বিশ^স্ত হতে পারেনি। আর ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আমেরিকা কিছু করবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত, দীর্ঘদিন দলীয় কাজে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের লন্ডনে অবস্থানের কারণেও স্বাভাবিক অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মতো কূটনৈতিক তৎপরতায়ও পিছিয়ে পড়ছে দলটি। শিগগিরই এ অবস্থার কোনো পরিবর্তনেরও আশা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।






















