বগুড়া পৌরসভার বর্ধিত ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লুৎফর রহমান মিন্টু হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। এদিকে কাউন্সিলরের কারাগারে থাকায় ওয়ার্ডের সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে, মানিকচক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মমতাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই কাউন্সিলরের কার্যালয়।
অনুসন্ধানের উঠে আসে, এলাকায় টেন্ডার বাণিজ্য, জমি দখল, ফ্লাট নির্মাণের অনুমোদনে লাখ লাখ টাকার অর্থ আত্মসাৎ, বিচার সালিশের নামে অর্থ বাণিজ্য সহ এমন কোন আইন-শৃংখলার অবনতির কাজ নেই যা করেননা কাউন্সিলর মিন্টু।
ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সদস্য থেকে আসাদুর রহমান দুলু (বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক) এর রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। পরে সুবিধা না পেয়ে (বর্তমান বগুড়া সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) আবু সুফিয়ান শফিকের হাত ধরে রাজনীতির ফ্রন্টলাইনে আসেন এই মিন্টু। স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেই নেতাদের মন কেড়ে নেন। বর্তমানে কাউন্সিলর মিন্টু সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বগুড়া সদর উপজেলা শাখার সাপোর্টে বগুড়া পৌরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বনে যান। তারপর থেকেই ভাগ্যের চাকা খুলে যায় কাউন্সিলর মিন্টুর।
ব্যবসায়িক লেনদেনকে কেন্দ্র করে শাওন ও তার বাহিনীর লোকজন গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে সদরের জয়বাংলাহাট বন্দর কমিটির সভাপতি ও সদরের কুটুরবাড়ি দক্ষিণপাড়ার গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মুরগি ব্যবসায়ী সেলিম মিয়াকে কুটুরবাড়ি মধ্যপাড়ায় পথরোধ করেন। এরপর হত্যার উদ্দেশ্যে চাইনিজ কুড়াল এবং চাকু দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হাত ও পায়ের রগ কাটা হয়।
রক্তাক্ত সেলিমকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এ ঘটনায় তার বাবা গিয়াস উদ্দিন গতবছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সদর থানায় বিভিন্ন ধারায় মামলা করেন। বগুড়া র্যাব-১২ (১০ অক্টোবর) আসামী শাওনকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় পরের দিন সকাল ১০টার দিকে রোহান ও আহত সেলিম বগুড়া চিফজুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যান।
বুধবার সকালে ইজিবাইক থেকে আদালতের সামনে নামার পরই গিয়াস উদ্দিন ও তার বড় ছেলে মিঠুনসহ দুইজন দুর্বৃত্ত তাদের ঘিরে ফেলেন। জোরপূর্বক তাদের একটি সিএনজিতে উঠিয়ে অপহরণ করে সদরের রাজাপুর ইউনিয়নে নিয়ে যান। সেখানে মন্ডলধরন গ্রামের কাজলের বাগানে নিয়ে দড়ি দিয়ে রোহান ও সেলিমকে হাত বেঁধে ফেলা হয়। এরপর গিয়াস সহ তার দুই ছেলে মিঠুন ও সাগর হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকা ৫ থেকে ৭ জন দুর্বৃত্ত লাঠিসোটা, রড ও এসএস পাইপ দিয়ে প্রায় একঘণ্টা তাদের বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে রোহান জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাদের আবারও সিএনজিতে উঠিয়ে জয়বাংলা হাটে ফেলে রেখে যায়।
স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে ১১ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জয়বাংলাহাট থেকে রোহানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত রোহান বগুড়া সদরের মানিকচক গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে।
পরে রোহান হত্যার বিচারের দাবিতে ১২ অক্টোবর দুপুরে সদর উপজেলার মানিকচক এলাকায় ২য় বাইপাস সড়কে দুই দফা মিছিল করেন স্বজনরা। মিছিলে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ অংশ নেয়। এসময় মিছিলে অংশ নেয়া এলাকাবাসী রোহান হত্যায় জড়িত
কাউন্সিলর মিন্টু, সাবেক ইউপি সদস্য গিয়াস ও তার লোকজনের ফাঁসির দাবি জানান৷
হত্যায় জড়িত রাজাপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন কাউন্সিলর মিন্টুর আপন মামা। মামলার বাদীর দাবি কাউন্সিলর মিন্টুর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে এবং হত্যার সাথে কাউন্সিলর মিন্টু সরাসরি জড়িত ছিল বলেও মামলায় উল্লেখ করেন তিনি। ৭ই ডিসেম্বর সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের কুটুরবাড়ি গ্রামের মৃত লাল মোহাম্মদের ছেলে কৃষক লীগ নেতা গিয়াস (৫৫) ও তার ছেলে সাগর মিয়া (১৮) গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলার পরপরই গাঢাকা দিয়েছিলো কাউন্সিলর মিন্টু। গাঢাকা দেবার পর থেকেই ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নাগরিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। জন্ম সনদ, চারিত্রিক সনদ, ফ্ল্যাট নির্মাণের অনুমোদন, পৌরসভার বিধি-বিধানের আওতাভুক্ত সকল কার্যক্রমে হয়রানী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরে কাউন্সিলর মিন্টু আদালতে আত্মসমর্পণ করতে আসলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে প্রেরণ করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চারিত্রিক সনদ তুলতে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ভোগান্তিতে পড়েছেন এক শিক্ষার্থী। পরে পৌরসভা থেকে উঠাতে হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফনির মোড় এলাকার একজন ব্যাবসায়ী জানান, বাইপাস সড়কের পাশে একটি ফ্ল্যাটের কাজ করছিলাম। নিচে মার্কেট অথবা গোডাউন করে উপরে বাসা করে থাকার চিন্তা করছিলাম। কিন্তু ফ্ল্যাটের অনুমোদন নিতে গেলে কাউন্সিলর মিন্টু ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অপারগতা স্বীকার করায় সে অনুমোদন দেয়নি। পরে স্থানীয় মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে ফ্ল্যাটের কাজ শুরু করার সময় একদল সন্ত্রাসী বাহিনী এসে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বলে এক ঘন্টার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা সহ মিন্টু ভাইয়ের অফিসে আসবেন। ভাইয়ের সাথে সমঝোতা না করলে আপনার কাজ বন্ধ করে দেয়া হবে। পরে তিনি বারবার কাউন্সিলরের সাথে কথা বলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছেন কিন্তু তাতে আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয় কাউন্সিলর মিন্টু। বলে তোর কোন বাপ আছে আমি মিন্টু কাউন্সিলর থাকাকালীন কোন বাপ এখানে বিল্ডিং নির্মাণ করতে পারবে না। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তার বিল্ডিং এর রড সিমেন্ট এখন মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নির্মাণ করা হয়নি স্বপ্নের ফ্ল্যাট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরোও একটি প্লাস্টিক কারখানার ম্যানেজার জানান, হঠাৎ কাউন্সিলর লোকজন পাঠিয়ে দেয় এবং বলে আজকের মধ্যেই কাউন্সিলর এর সাথে জরুরী ভাবে দেখা করতে। কাউন্সিলরের সাথে দেখা করলে তিনি জানান জরুরী ভাবে তাকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে না হলে ব্যবসা বন্ধ করে দেবে। পরে মালিকের সাথে আলোচনা করে মালিক নিজে অনুরোধ করে ৮ লাখ টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করে।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, এক সময় মিন্টুর বাবা দিনমজুর হিসেবে অন্যের বাড়িতে এবং জমিতে কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। অসহায়ের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠা মিন্টুর অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। তার কার্যক্রমে অতিষ্ট ওয়ার্ডবাসী সহ এলাকার ব্যবসায়ীরা।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বগুড়া শহর একটি ভালো মানের ব্যবসায়িক এলাকা। যেহেতু বেসিক শিল্প এলাকার অদূরেই কাউন্সিলর অফিস। আর কাউন্সিলর অফিসকে ঘিরেই বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান সহ ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন কোম্পানির শাখা অফিস করেছেন বগুড়ায়। মানিকচক এলাকায় বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় ভাগ্যের চাকা খুলে যায় মিন্টুর। আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠার মত মিন্টু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বেদার উদ্দিনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ঘটনার পর থেকেই কাউন্সিলর লুৎফর রহমান মিন্টু পলাতক ছিলেন। পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।


























